গৌস সিবানী
উত্তর প্রদেশের প্রয়াগরাজ শহরে অবস্থিত এলহাবাদ বিশ্ববিদ্যালয় ভারতের একটি প্রখ্যাত কেন্দ্রীয় বিশ্ববিদ্যালয়। শিক্ষার দীর্ঘ ইতিহাস বহনকারী এই প্রতিষ্ঠানটি প্রথমে একটি কলেজ হিসেবে আত্মপ্রকাশ করেছিল। পরে ২৩ সেপ্টেম্বর ১৮৮৭ সালে সংসদের একটি আইনের মাধ্যমে এটি জাতীয় স্তরের প্রতিষ্ঠান হিসেবে স্বীকৃতি লাভ করে। স্বাধীনতার পর, ভারতীয় সংসদ কর্তৃক প্রণীত এলহাবাদ বিশ্ববিদ্যালয় আইন, ২০০৫-এর অধীনে বিশ্ববিদ্যালয়টি পুনরায় কেন্দ্রীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের মর্যাদা পায়।
এলহাবাদ বিশ্ববিদ্যালয়কে যথার্থই ‘জ্ঞান-এর দুর্গ’ বলা হয়। এটি ভারতের প্রাচীনতম ও ঐতিহ্যবাহী বিশ্ববিদ্যালয়গুলির অন্যতম, যা কেবল শিক্ষাদানের ক্ষেত্রেই নয়, গবেষণা, সভ্যতা ও জাতীয় চেতনার বিকাশেও গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে এসেছে। গঙ্গা, যমুনা ও সরস্বতী নদীর পবিত্র ত্রিবেণী সঙ্গম যেমন এলহাবাদ শহরকে বিশেষ পরিচিতি দিয়েছে, তেমনি এই শহরের গৌরবের সঙ্গে অঙ্গাঙ্গিভাবে যুক্ত রয়েছে এলহাবাদ বিশ্ববিদ্যালয়ের নাম।
এলহাবাদ বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রধান ক্যাম্পাস
বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রধান ক্যাম্পাসটি ‘সেনেট হাউস’ নামে পরিচিত, যা ইউনিভার্সিটি রোডে অবস্থিত। এই প্রতিষ্ঠানের ভিত্তি স্থাপিত হয়েছিল এমন এক দর্শনের উপর, যেখানে জ্ঞানের প্রসার কেবল পাঠ্যপুস্তকে সীমাবদ্ধ না থেকে সমাজ, গবেষণা ও সৃজনশীলতার সমন্বয়ে বিকশিত হবে। এই চিন্তাধারাকে বাস্তবে রূপ দিয়েই এলহাবাদ বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষার নানা ক্ষেত্রে নিজের একটি স্বতন্ত্র পরিচয় গড়ে তুলেছে।
বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রশাসনিক দায়িত্বে রয়েছেন উপাচার্য, আর আচার্য এই প্রতিষ্ঠানের সর্বোচ্চ অভিভাবক হিসেবে দিকনির্দেশনা প্রদান করেন। তাঁদের নেতৃত্বে এলহাবাদ বিশ্ববিদ্যালয় আধুনিক সময়ের প্রয়োজন অনুযায়ী ক্রমাগত অগ্রসর হয়ে চলেছে।
এলহাবাদ বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষাদান ও গবেষণার কার্যক্রম পরিচালিত হয় বিভিন্ন একাডেমিক বিভাগের মাধ্যমে। এখানে চারুকলা, সমাজবিজ্ঞান, বিজ্ঞান, আইন, বাণিজ্য ও ব্যবস্থাপনা বিজ্ঞানের মতো গুরুত্বপূর্ণ বিভাগ রয়েছে। উর্দু, দর্শন, ইতিহাস, ইংরেজি, পদার্থবিদ্যা, রসায়ন, জীববিজ্ঞান, গণিত ও অর্থনীতির মতো বিষয় পড়ানো হয়। শিক্ষার্থীরা স্নাতক, স্নাতকোত্তর ও গবেষণা স্তরে উচ্চশিক্ষার সুযোগ লাভ করে।
প্রতীকী ছবি
গবেষণার ক্ষেত্রে এলহাবাদ বিশ্ববিদ্যালয় একটি বিশেষ অবস্থান অর্জন করেছে। এখানে রয়েছে একাধিক গবেষণা কেন্দ্র ও প্রতিষ্ঠান, যেমন সেন্টার অব বায়োটেকনোলজি, সেন্টার ফর এনভায়রনমেন্টাল সায়েন্স, ন্যানোটেকনোলজি অ্যাপ্লিকেশন সেন্টার, ইনস্টিটিউট অব গান্ধী থট অ্যান্ড পিস স্টাডিজ এবং ডিজাইন ইনোভেশন সেন্টার। এসব কেন্দ্র একদিকে যেমন একাডেমিক গবেষণাকে সমৃদ্ধ করছে, তেমনি অন্যদিকে সমাজের বাস্তব সমস্যার কার্যকর সমাধানের পথও দেখাচ্ছে।
পরিকাঠামো ও সুযোগ-সুবিধার ক্ষেত্রেও এলহাবাদ বিশ্ববিদ্যালয় উল্লেখযোগ্য উন্নতি সাধন করেছে। আধুনিক গ্রন্থাগার, ডিজিটাল লার্নিং সেন্টার, কম্পিউটার ল্যাব, উন্নত গবেষণা সরঞ্জামে সজ্জিত সেন্ট্রাল ইনস্ট্রুমেন্টেশন ফ্যাসিলিটি, স্বাস্থ্যকেন্দ্র, ছাত্রাবাস ও খেলার মাঠ, সবই এখানে উপলব্ধ। ছাত্র ও ছাত্রীদের জন্য পৃথক হোস্টেল রয়েছে, যেমন অমরনাথ ঝা হোস্টেল, ডায়মন্ড জুবিলি হোস্টেল এবং শতাব্দী গার্লস হোস্টেল, যা শিক্ষার্থীদের নিরাপদ ও সহায়ক পরিবেশ প্রদান করে।
শিক্ষার্থীদের সার্বিক বিকাশ নিশ্চিত করতে এলহাবাদ বিশ্ববিদ্যালয় নিয়মিত সহ-পাঠ্যক্রমমূলক কার্যক্রমের আয়োজন করে। কর্মশালা, সেমিনার, থিয়েটার কার্যক্রম, চলচ্চিত্র প্রদর্শনী ও বিতর্ক প্রতিযোগিতা এর অন্তর্ভুক্ত। পাশাপাশি ক্যারিয়ার কাউন্সেলিং, প্লেসমেন্ট সেল ও বৃত্তির সুবিধাও শিক্ষার্থীদের জন্য উপলব্ধ। অ্যান্টি-র্যাগিং সেল, মহিলা সেল ও অভিযোগ নিষ্পত্তি ব্যবস্থার মাধ্যমে বিশ্ববিদ্যালয় একটি স্বচ্ছ, নিরাপদ ও ন্যায়সঙ্গত শিক্ষাবাতাবরণ নিশ্চিত করে।
এলহাবাদ বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রাঙ্গণ
এলহাবাদ বিশ্ববিদ্যালয় কেবল একটি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান নয়, এটি একটি শিক্ষাগত আন্দোলন, যা প্রজন্মের পর প্রজন্ম ধরে জ্ঞানের আলো বহন করে চলেছে। এই প্রতিষ্ঠানের প্রাঙ্গণ থেকেই উঠে এসেছেন অসংখ্য খ্যাতনামা পণ্ডিত, লেখক, বিজ্ঞানী ও জাতীয় নেতা, যাঁরা তাঁদের কর্ম ও চিন্তাধারার মাধ্যমে শুধু ভারত নয়, সমগ্র বিশ্বে প্রভাব ফেলেছেন।
আজও এলহাবাদ বিশ্ববিদ্যালয় তার ঐতিহ্য অক্ষুণ্ণ রেখে আধুনিক শিক্ষার চাহিদার সঙ্গে সামঞ্জস্য বজায় রেখে এগিয়ে চলেছে। নিঃসন্দেহে, এটি এমন এক শিক্ষাগত স্তম্ভ, যার ওপর কেবল ভারত নয়, সমগ্র উপমহাদেশ গর্ব অনুভব করে। এর শিক্ষাদর্শ, পরিবেশ ও দৃষ্টিভঙ্গি ভবিষ্যতেও জ্ঞান ও বিজ্ঞানের আলো জ্বালিয়ে রাখবে।
(লেখক ‘আওয়াজ দ্যা ভয়েস উর্দু’-এর সঙ্গে যুক্ত। এলহাবাদ বিশ্ববিদ্যালয় সম্পর্কে )