পিতার ঐতিহ্যের পথে, গুয়াহাটির পুজো মণ্ডপে দীপ আহমেদের নতুন সৃষ্টির ছোঁয়া

Story by  Munni Begum | Posted by  Aparna Das • 3 d ago
ঐতিহাসিক 'ব্যাবিলন ঝুলন্ত উদ্যান'-এর আদলে শিল্পী দীপ আহমেদ এবং তাঁর নির্মিত পুজো  মণ্ডপের একটি দৃশ্য।
ঐতিহাসিক 'ব্যাবিলন ঝুলন্ত উদ্যান'-এর আদলে শিল্পী দীপ আহমেদ এবং তাঁর নির্মিত পুজো মণ্ডপের একটি দৃশ্য।
 
মুন্নী বেগম/গুয়াহাটি

শিল্পই যখন রক্তে মিশে থাকে, তখন প্রজন্ম থেকে প্রজন্মে তা এক ঐতিহ্যে রূপ নেয়। গুয়াহাটির শিল্পী দীপ আহমেদও সেই ধারার উত্তরসূরি। পিতা নুরুদ্দিন আহমেদের পদাঙ্ক অনুসরণ করে তিনি এবারে বিষ্ণুপুর বিমলানগর সর্বজনীন দুর্গাপুজোর মণ্ডপকে নতুন শিল্পসৌকর্যে সাজিয়ে তুলেছেন।
 
পিতা নুরুদ্দিনের সঙ্গে ভাস্কর্য শিল্পে পদার্পণ করা দীপ আহমেদ এবার পুজো মণ্ডপের পাশাপাশি প্যান্ডেলটিকেও বিশেষভাবে আকর্ষণীয় করে তুলেছেন। তিনি বিগত বছরের মতো এবারও পুজোর বিষয়বস্তু হিসেবে বেছে নিয়েছেন ঐতিহাসিক ‘বাবিলনের হ্যাংগিং গার্ডেন’।
 
বিষ্ণুপুর বিমলানগর সার্বজনীন দূর্গাপুজো  মন্ডপের একটি দৃশ্য
 
বিশ্বের সাতটি আশ্চর্যের অন্যতম ছিল বাবিলনের হ্যাংগিং গার্ডেন। ইতিহাসবিদদের মতে, এই উদ্যানটি প্রাচীন মেসোপটেমিয়ায় ছিল, যা বর্তমানে ইরাকে অবস্থিত। খ্রিস্টপূর্ব পঞ্চম থেকে ষষ্ঠ শতাব্দীর মধ্যে বাবিলনের রাজা নেবুচাডনেজার দ্বিতীয় তাঁর স্ত্রী অ্যামিটিস মিডিয়াকে আনন্দিত করার জন্য এই উদ্যান নির্মাণ করেছিলেন বলে জানা যায়।
 
‘আওয়াজ-দ্য ভয়েস’-এর সঙ্গে কথোপকথনে শিল্পী দীপ আহমেদ বলেন, “এবার আমাদের পুজোর থিম হলো বাবিলনের হ্যাংগিং গার্ডেন। বিশ্বের সাত আশ্চর্যের একটি ছিল এই উদ্যান।
 
এই উদ্যানটি নির্মাণের সময় অর্থাৎ হাজার বছর আগে এত উন্নত প্রযুক্তি ব্যবহার সম্ভব ছিল না, কিন্তু সেই সময়ের প্রকৌশল কৌশল ছিল অত্যন্ত শক্তিশালী। মানুষ নদীর পানি ৩০০ ফুট ওপরে তুলতে সক্ষম হয়েছিল চাকতির সাহায্যে, যাতে উদ্যানটিতে পানি পৌঁছানো যায়। আর সেই পানি ঝরনার মতো আবার নিচে নেমে আসত।
 
যা আজও বিদ্যুৎ বা পাম্প ছাড়া করা প্রায় অসম্ভব। তাই এমন একটি ঐতিহ্যকে মানুষের সামনে আনতে আমি এবারের পুজোর থিম হিসেবে বাবিলনের হ্যাংগিং গার্ডেনকে বেছে নিয়েছি। আমরা ৩০০ ফুট উচ্চতায় নির্মাণ করতে না পারলেও প্রায় ৬০ ফুট উঁচুতে একটি প্রতিরূপ তৈরি করেছি, যেখানে মানুষ ঝরনার ভেতর দিয়ে গিয়ে বাগানটি দেখতে পারবে এবং সেই সহস্রাব্দ পুরনো সভ্যতার অভিজ্ঞতা অর্জন করতে পারবে।”
 
বিষ্ণুপুর বিমলানগর সর্বজনীন দুর্গাপুজোর মণ্ডপে নির্মিত মায়ের প্রতিমা
 
সে সময় কোনো আধুনিক যন্ত্রপাতি না থাকলেও, প্রকৌশলের উৎকৃষ্ট দক্ষতা ব্যবহার করে মানুষ এক অলৌকিক স্থাপত্য নির্মাণ করেছিল। নদী থেকে পানি তুলে গাছ, ফুল, ফলের গাছ দিয়ে সাজানো হয়েছিল সেই উদ্যান। সেখানে পানির ফোয়ারার শব্দ, গাছপালা ও লতাপাতার সৌন্দর্য মিলিয়ে এক অনন্য দৃশ্য ফুটে উঠেছিল। যদিও আজ সেই উদ্যান ইতিহাসের গর্ভে হারিয়ে গেছে, তবুও ইতিহাসের পাতায় তা অমর স্থাপত্য হিসেবে রয়ে গেছে।
 
দীপ আহমেদ বলেন, “আমাদের এই কাজে প্রায় ৪২–৫০ জন স্থানীয় কর্মী যুক্ত আছেন। তারা নলবাড়ি, য়গাঁও, বরপেটা প্রভৃতি জায়গার। আমাদের এই ডিজাইনে ৬০ ফুট ওপর থেকে প্রবাহিত তিনটি ঝরনা থাকবে। উদ্যানটিতে আমরা প্রাকৃতিক ও কৃত্রিম দুই ধরনের গাছপালা ব্যবহার করেছি। প্যান্ডেল তৈরির জন্য আমরা কাঠ, বাঁশ, প্লাইউড, ডাল, থার্মোকল, সিন্থেটিক রং ব্যবহার করছি।”
 
উল্লেখ্য, ছোটবেলা থেকেই শিল্পকলার প্রতি আকৃষ্ট দীপ আহমেদ তাঁর পিতা নুরুদ্দিন আহমেদের কাছ থেকে এই শিল্পকলা রপ্ত করেছেন। নুরুদ্দিন আহমেদ ১৯৭৫ সাল থেকে হিন্দু ধর্মাবলম্বীদের দেবদেবীর মূর্তি নির্মাণ এবং চিত্রাঙ্কন করে আসছেন। ইসলাম ধর্মে যেহেতু মূর্তি উপাসনা নিষিদ্ধ, তাই প্রথমদিকে তাঁকে অনেক চ্যালেঞ্জের সম্মুখীন হতে হয়েছিল। তবে বর্তমানে হিন্দু ও মুসলমান উভয়েই তাঁর কাজকে স্বীকৃতি দিয়েছে ও প্রশংসা করেছে। আর এখন তাঁর সেই উত্তরাধিকারকে এগিয়ে নিচ্ছেন পুত্র দীপ।
 
দীপ বলেন, “আমি ছোট থেকে বাবার কাজ দেখে বড় হয়েছি। ফলে ছোট থেকেই শিল্পকলার প্রতি আকৃষ্ট হয়েছিলাম। বাবার কাছ থেকে আমি এই কলার সূক্ষ্ম দিকগুলো শিখেছি। এখনকার পুজো আমি প্রায় একাই করেছি, কারণ কিছু ব্যস্ততার জন্য বাবা আগের মতো সময় দিতে পারেননি। তবে মাঝেমধ্যে তিনি এসে আমার কাজ পর্যালোচনা করেন। আমি নিজেকে সৌভাগ্যবান মনে করব যদি বাবার কাছ থেকে পাওয়া এই শিল্পকলা আমি এগিয়ে নিতে পারি। বাবার সময়ে এত প্রযুক্তি ছিল না, এখন আমি আধুনিক প্রযুক্তি ব্যবহার করে নতুনত্ব আনতে চাই।”
 
বিষ্ণুপুর বিমলানগর সার্বজনীন দূর্গাপুজো  মন্ডপের একটি দৃশ্য
 
প্রায় চার দশক ধরে দেবী দুর্গার মূর্তি নির্মাণকারী শিল্পী নুরুদ্দিন প্রতি বছর পুজোর প্যান্ডেলের ডিজাইনে দীপ আহমেদকে সহায়তা করতেন। তবে এবারের বিষ্ণুপুর বিমলানগর সর্বজনীন দুর্গাপুজোর প্যান্ডেলের সম্পূর্ণ নকশা ও প্রদর্শনীর কাজ এককভাবে করেছেন দীপ আহমেদ।
 
দীপ বলেন, “যেহেতু এবারের পুজোর প্যান্ডেলটি বাবিলনের হ্যাংগিং গার্ডেনের আদলে তৈরি, তাই আমি যথাসম্ভব সেই উদ্যানের অভিজ্ঞতা দর্শকদের দিতে চেষ্টা করেছি। এর মাধ্যমে আমরা দর্শকদের সেই পৌরাণিক যুগে নিয়ে যাওয়ার একটি প্রয়াস করেছি। আমরা এক মাস আগে থেকেই এই কাজ শুরু করেছিলাম। প্যান্ডেলের ভেতরে ও বাইরে দর্শনার্থীদের নিরাপত্তার দিকে লক্ষ্য রেখে যথেষ্ট সংখ্যক স্বেচ্ছাসেবকের ব্যবস্থাও করেছি।”
 
পিতার কাছ থেকে পাওয়া ভাস্কর্য শিল্পের ঐতিহ্য পুত্রের হাতে নতুন রূপ পেয়েছে। বিষ্ণুপুর বিমলানগরের পুজো মণ্ডপে বাবিলনের হ্যাংগিং গার্ডেনের প্রতিরূপ একদিকে যেমন মানবসভ্যতার ঐতিহাসিক বিস্ময়কে উপস্থাপন করছে, তেমনি অসমীয় শিল্পকলার সঙ্গেও মিশিয়ে তুলছে। শিল্প, ঐতিহ্য ও সৃষ্টিশীলতার সমন্বয়ে গড়া এই পুজো প্রমাণ করেছে, সীমিত বাজেটের তুলনায় সৃজনশীলতাই আসল শক্তি।
 
দীপ আহমেদ বলেন, “চিকিৎসক বা প্রকৌশলীর মতো শিল্পও সমান গুরুত্বপূর্ণ। ইন্টেরিয়র ডিজাইনিং, ইভেন্ট ম্যানেজমেন্ট, সবকিছুতেই শিল্প জড়িয়ে আছে। ভাস্কর্য শিল্প এমন একটি ক্ষেত্র যেখানে যুবসমাজের জন্য অসীম সুযোগ রয়েছে। কারণ এই শিল্প কেবল পুজোমণ্ডপে সীমাবদ্ধ নয়, এটি একটি পেশাগত ক্ষেত্রে রূপ নিয়েছে। তবে অন্য রাজ্যের তুলনায় আমাদের এখানে বাজেট ও উপকরণের অভাব রয়েছে। কিন্তু সীমিত বাজেটে ভালো কাজ করতে হবে এবং নতুন প্রযুক্তি ব্যবহার করে নতুনত্ব আনতে হবে। এই ক্ষেত্রে সবার সহযোগিতা প্রয়োজন। শুধু ভাবলেই চলবে না, নবপ্রজন্মকে এগিয়ে আসতে হবে। যদি কেউ আমাদের কাছ থেকে এই শিল্প শিখতে চায়, তবে আমি ও আমার বাবা সানন্দে তাকে শেখাতে প্রস্তুত। যাতে এই শিল্পধারা এগিয়ে যেতে পারে।”
 
 
ঐতিহাসিক 'ব্যাবিলন ঝুলন্ত উদ্যান'- এর আদলে নির্মিত বিষ্ণুপুর বিমলনগর সর্বজনীন দূর্গাপুজোর মন্ডপ 
 
শিল্প, সৃষ্টিশীলতা ও ঐতিহ্য, এই তিনটি শব্দে মিশ্রিত প্রতিফলন দেখা গেছে গুয়াহাটি মহানগরের বিষ্ণুপুর বিমলানগর সর্বজনীন দুর্গাপুজোর এবারের মণ্ডপে। ঐতিহাসিক বাবিলনের হ্যাংগিং গার্ডেনকে থিম করে তৈরি এই মণ্ডপে শিল্পীর কল্পনা ও শিল্পকলার নিখুঁত সংমিশ্রণ দেখা যাচ্ছে।
 
বিষ্ণুপুর বিমলানগর সর্বজনীন দুর্গাপুজো সমিতির সাংস্কৃতিক সম্পাদক বিকি রায় বলেন, “আমাদের পুজো ষষ্ঠীর দিন উদ্বোধন হয়েছে। প্রতিবছরের মতো এ বছরও হাজার হাজার ভক্ত ও দর্শনার্থী পুজোমণ্ডপে সমবেত হচ্ছেন। আমরা প্রতি বছরই দর্শকদের জন্য কিছু বিশেষ আয়োজনের চেষ্টা করি। এবারে প্রায় ৩৫ লক্ষ টাকার বাজেটে পুজোটিকে অন্যদের তুলনায় ব্যতিক্রমী করে তুলতে চেয়েছি। তবে এবারের পুজোর পরিবেশ কিছুটা স্তব্ধ, কারণ সম্প্রতি আমরা আমাদের হৃদয়ের খুব কাছের শিল্পী জুবিন দাকে হারিয়েছি। তাই শ্রদ্ধাঞ্জলি জানানোর উদ্দেশ্যে সব সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান বাতিল করা হয়েছে।পুজোমণ্ডপের ভেতরে তাঁর প্রতিকৃতি রাখা হয়েছে এবং তাঁর গান বাজানোরও ব্যবস্থা করা হয়েছে।”