নয়াদিল্লি
বাংলাদেশে এক হিন্দু যুবকের কথিত নৃশংস হত্যাকাণ্ডকে ঘিরে সামাজিক মাধ্যমে তীব্র ক্ষোভ ছড়িয়ে পড়েছে। এই ঘটনার কড়া নিন্দা করেছেন ভারতের বহু মুসলিম যুবক, ধর্মীয় পণ্ডিত ও প্রভাবশালী সমাজমাধ্যম ব্যক্তিত্ব। তাঁদের বক্তব্যে উঠে এসেছে, এই ঘটনা কেবল একটি অপরাধ নয়, বরং মানবতা ও আইনের শাসনের ওপর সরাসরি আঘাত।
সামাজিক মাধ্যমে ছড়িয়ে পড়া বিবরণ অনুযায়ী, ‘হাদি’ নামে এক বিপ্লবী নেতার হত্যার পর বাংলাদেশে রাজনৈতিক ও ধর্মীয় উত্তেজনা চরমে ওঠে। এই উত্তপ্ত পরিস্থিতির মধ্যেই এক হৃদয়বিদারক ঘটনা ঘটে বলে অভিযোগ, এক হিন্দু যুবককে জনতার হাতে নির্মমভাবে মারধর করা হয়, গুরুতর আহত অবস্থায় গাছ থেকে ঝুলিয়ে রাখা হয় এবং পরে তাকে আগুনে পুড়িয়ে হত্যা করা হয়। এই ভয়াবহ ঘটনার বিবরণ বাংলাদেশেই নয়, ভারতেও গভীর শোক ও ক্ষোভের সৃষ্টি করেছে।
ভারতে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে একের পর এক ভিডিও ও বিবৃতি প্রকাশ করে বহু মুসলিম যুবক বাংলাদেশের ধর্মীয় উগ্রবাদ ও সংখ্যালঘুদের ওপর সহিংসতার বিরুদ্ধে সরব হয়েছেন। তাঁদের অনেকেই এই ঘটনাকে ‘লজ্জাজনক’, ‘ইসলামবিরোধী’ এবং ‘মৌলিক মানবিক মূল্যবোধের পরিপন্থী’ বলে অভিহিত করেছেন।
ফেসবুকে ভাইরাল হওয়া একটি ভিডিওতে মুম্বইয়ের যুব সমাজকর্মী মুমতাজ শেখ ঘটনাটির তীব্র নিন্দা জানান। তিনি বাংলাদেশের সমাজ ও উগ্রপন্থী গোষ্ঠীগুলির কড়া সমালোচনা করেন। ওই ভিডিওতে তিনি দাবি করেন, নিহত যুবকের নাম দীপু চন্দ্র দাস এবং অভিযোগ অনুযায়ী কিছু কথা বলার জেরে ক্ষুব্ধ জনতার নিশানা হন তিনি।
ভিডিওতে মুমতাজ শেখ আবেগঘন কণ্ঠে বলেন, “বাংলাদেশে কী হচ্ছে, আপনারা কি বুঝতে পারছেন? দীপু চন্দ্র দাস নামে এক যুবক নাকি কিছু বলেছিল, আর কিছু কাপুরুষ মানুষ একত্র হয়ে এমন একটি কাজ করেছে, যার বর্ণনা দেওয়ার মতো ভাষা নেই।”
তিনি আরও জোর দিয়ে বলেন, কোনও ধর্মগ্রন্থই জনতার হাতে বিচার ও শাস্তির অনুমতি দেয় না। “কোনও বইয়ে লেখা নেই যে কেউ কোনও ধর্ম সম্পর্কে কিছু বললে, তাকে এভাবে শাস্তি দেওয়া যাবে। যদি ওখানে কেউ শুনে থাকেন, বুঝে নিন, এই মুহূর্তে আপনাদের দেশে আইন নেই, আছে শুধু জনতার শাসন,” বলেন তিনি।
নীরবতার সমালোচনা করে শেখ বলেন, অন্যায় দেখে চুপ থাকা মানেই অপরাধের অংশীদার হওয়া। “ভুলকে ভুল বলতে না পারলে, আপনি নিজেও ভুল। লক্ষ লক্ষ অনুসারী থাকা বড় বড় প্রভাবশালীরা চুপ করে আছেন, কিন্তু আমি চুপ থাকব না। নিজের সম্প্রদায়ের কেউ অন্যায় করলেও আমি তার প্রতিবাদ করব,” বলেন তিনি।
তিনি আরও দাবি করেন, বহু বাংলাদেশি নাগরিক ভারতে কাজ করে রোজগার করেন এবং এখান থেকে অর্থ পাঠান। তাই ভারতের দিক থেকে আওয়াজ উঠলে আন্তর্জাতিক মহলে বিষয়টি আরও গুরুত্ব পেতে পারে। এই কারণে তিনি ভিডিওটি ব্যাপকভাবে ছড়িয়ে দেওয়ার আহ্বান জানান, যাতে চাপ তৈরি হয়ে যথাযথ ব্যবস্থা নেওয়া হয়।
এ ধরনের আরও বহু ভিডিও ইতিমধ্যেই সামাজিক মাধ্যমে প্রকাশ পেয়েছে, যেখানে ধর্মীয় পণ্ডিত, বুদ্ধিজীবী ও সাধারণ মানুষ বাংলাদেশে ঘটে যাওয়া এই সহিংসতার বিরুদ্ধে মুখ খুলেছেন। পর্যবেক্ষকদের মতে, এটি একটি স্পষ্ট প্রবণতা, ভারতের মুসলিম সমাজের একাংশ সীমান্ত পেরিয়েও ধর্মীয় উগ্রবাদ ও গণহিংসার বিরুদ্ধে প্রকাশ্যে অবস্থান নিচ্ছেন।
আরেক যুবক, ওয়াইস আহমেদ কাসমি, নিজের ভিডিওতে ঘটনাটিকে ‘যন্ত্রণাদায়ক ও অগ্রহণযোগ্য’ বলে অভিহিত করেন। তাঁর বক্তব্য অনুযায়ী, প্রাথমিক তথ্যে জানা যাচ্ছে, নিহত যুবকের বিরুদ্ধে ধর্ম অবমাননার অভিযোগ তোলা হয়েছিল, নাকি তিনি মহানবী হজরত মুহাম্মদ (সা.) সম্পর্কে কিছু মন্তব্য করেছিলেন।
কাসমি বলেন, “বাংলাদেশে এক মুসলিম জনতা এক হিন্দু মানুষকে পিটিয়ে হত্যা করেছে। অভিযোগ থাকলেও, যে সহিংসতা হয়েছে তা চরম ও অন্যায্য।” তিনি উল্লেখ করেন, বাংলাদেশের শীর্ষ নেতৃত্ব এই ঘটনার নিন্দা করেছেন এবং সরকার কঠোর ব্যবস্থা নেওয়ার আশ্বাস দিয়েছে, এমনকি ইতিমধ্যেই কয়েকজনকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে বলেও খবর।
তুলনা টেনে কাসমি বলেন, এই ধরনের সহিংসতা সর্বত্রই নিন্দনীয়। “ভারতে গরু বা অন্য কোনও অজুহাতে মুসলিমদের সঙ্গে এমন ঘটনা ঘটলে আমরা গভীর কষ্ট পাই। তেমনই, পৃথিবীর যে কোনও প্রান্তে সংখ্যালঘুদের উপর আক্রমণ হলে তা কখনওই সমর্থনযোগ্য নয়,” বলেন তিনি। একই সঙ্গে তিনি অভিযোগ করেন, ভারতে অনেক সময় দোষীদের ফুলের মালা পরানো হয়, এই প্রবণতারও তিনি তীব্র সমালোচনা করেন।
“যদি কেউ সত্যিই ধর্ম অবমাননা করে থাকে, তাহলে সরকার ও আদালত আছে বিচার করার জন্য। আইন সেই কারণেই তৈরি, জনতার হাতে শাস্তি দেওয়ার জন্য নয়। এভাবে কাউকে হত্যা করা বর্বরতা। এমন কাজ করলে আপনারাও একই অপরাধের অংশীদার হয়ে যান,” বলেন কাসমি, একে মানবতার বিরুদ্ধে অপরাধ হিসেবে চিহ্নিত করে।
অন্য এক যুবক আফসার রজা মারকাজি তাঁর ভিডিওতে একই সুরে কথা বলেন। তিনি বলেন, সামাজিক মাধ্যমে সক্রিয় থাকলেই এই ঘটনার ভয়াবহতা চোখে পড়বে। “ধর্মের চশমা ছাড়াই যদি শুধুমাত্র মানবতার দৃষ্টিতে দেখি, তাহলে যে কোনও মানুষই বলবে, এটা ভুল,” বলেন তিনি।
তিনি প্রশ্ন তোলেন, “মানুষ ভুল করতেই পারে, কিন্তু শাস্তি দেওয়ার অধিকার জনতাকে কে দিয়েছে? বাংলাদেশে কি সংবিধান বা আইন নেই? সবাই যদি নিজের হাতে বিচার করতে শুরু করে, তাহলে কি কোনও দেশ টিকে থাকতে পারে?”
মারকাজি বাংলাদেশ সরকারের কাছে দাবি জানান, এই ঘটনার সঙ্গে যুক্ত সকলকে, বিশেষ করে যাঁদের ভিডিও ভাইরাল হয়েছে, দ্রুত গ্রেপ্তার করে সর্বোচ্চ শাস্তি নিশ্চিত করা হোক। একই সঙ্গে তিনি দর্শকদের অনুরোধ করেন, এই ধরনের ভিডিও আরও বেশি করে শেয়ার করতে, যাতে কর্তৃপক্ষের কাছে বার্তা পৌঁছায় এবং কার্যকর পদক্ষেপ নেওয়া হয়।
এই ঘটনা এবং তার বিরুদ্ধে ওঠা জোরালো প্রতিবাদ স্পষ্ট করে দিচ্ছে, ধর্মীয় উগ্রবাদ, সংখ্যালঘুদের নিরাপত্তা ও আইনের শাসন নিয়ে সীমান্ত পেরিয়ে একটি নতুন সংলাপ গড়ে উঠছে। বহু কণ্ঠ একসঙ্গে বলছে, ধর্মের নামে হিংসা পৃথিবীর কোথাওই গ্রহণযোগ্য নয়।