বলিউডের ষড়যন্ত্রের শিকার হয়েছিলেন কি কিংবদন্তি গায়ক মোহাম্মদ রফি ?

Story by  atv | Posted by  Sudip sharma chowdhury • 20 h ago
কিংবদন্তি গায়ক মোহাম্মদ রফি
কিংবদন্তি গায়ক মোহাম্মদ রফি
নতুন দিল্লি

‘আই দুনিয়া কে রাখওয়ালে’ এবং ‘মন তড়পত হরি দর্শন কো আজ’-এর মতো আইকনিক গান যিনি গেয়েছেন, সেই কিংবদন্তি গায়ক মোহাম্মদ রফি কি সত্যিই বলিউডের ষড়যন্ত্রের শিকার হয়েছিলেন? জনপ্রিয় গায়ক সুরেশ ওয়াডেকার এক পডকাস্ট সাক্ষাৎকারে দাবি করেছেন, মোহাম্মদ রফিকে ৯ বছরের জন্য চুক্তিবদ্ধ হওয়ার সুযোগ থেকে ইচ্ছাকৃতভাবে বঞ্চিত করা হয়েছিল।

ষাটের দশক পর্যন্ত মোহাম্মদ রফি ছিলেন বলিউডের একমাত্র প্রভাবশালী পুরুষ প্লেব্যাক গায়ক। কিন্তু তাঁর এই একচেটিয়া আধিপত্যে বাঁধা হয়ে উঠেছিলেন সেই সময়ের আরেক গায়ক কিশোর কুমার। কিশোর কুমারের গান, শক্তি সামন্ত পরিচালিত চলচ্চিত্র ‘আরাধনা’-র গানগুলি, যেখানে অভিনয় করেছিলেন সেখানে শর্মিলা ঠাকুর ও রাজেশ খান্না সেগুলো বিপুল জনপ্রিয়তা পেয়েছিল।

ওয়াডেকার বিবিসিকে দেওয়া এক সাক্ষাৎকারে বলেন, “ভাবুন তো, মোহাম্মদ রফির মতো এক মহান গায়ককে প্রায় আট থেকে নয় বছর পর্যন্ত গান গাওয়ার সুযোগই দেওয়া হয়নি। যাঁরা এই উদাহরণ তৈরি করেছিলেন, সেই একই সংগীত পরিচালকরা তাঁকেই চুপ করিয়ে দিয়েছিলেন। এমন একজন মহান শিল্পী, যাঁকে মানুষ ‘আল্লাহ মিঞা কি গায়’ বলে অভিহিত করত, তাঁকে বাধ্য করা হয়েছিল ঘরে বসে থাকতে।”

তিনি আরও বলেন, “রফি সাহেব ওই গায়কদের সবার থেকে অনেক ভাল গাইতেন, আর সম্ভবত সেটাই ছিল তাঁর সবচেয়ে বড় ভুল। হয়তো সেই কারণেই, ঈর্ষা ও বিরক্তির বশবর্তী হয়ে তাঁকে ইচ্ছাকৃতভাবে এক পাশে সরিয়ে রাখা হয়েছিল।”
 

 
প্রধানমন্ত্রী জওহরলাল নেহরুর সাথে মোহাম্মদ রফি
 
তিনি আরও বলেন, “১০০টা গানের মধ্যে যদি ৯৮টা গান একজন গায়ককে দেওয়া হয়, আর তারপর বলা হয় যে তিনি ‘ভাগ্যবান গায়ক’, তাহলে তিনি কীভাবে ভাগ্যবান হবেন না? যখন সব সুযোগ-সুবিধাই তাঁকেই দেওয়া হয়? তাহলে বাকি গায়করা কী শুধুই ঘা খাওয়ার জন্য এসেছে?”

এটা শুধু মোহাম্মদ রফির ক্ষেত্রেই নয়। সুরেশ ওয়াডেকার নিজেও এই পক্ষপাতিত্বের শিকার হয়েছিলেন। গায়কদের প্রতি এই মনোভাব তখন বেশ সাধারণ হয়ে উঠেছিল। ওয়াডেকার আরও বলেন, “প্রতি বছর ১০০টা গান তৈরি হয়। আপনি যদি আপনার প্রিয় গায়ককে ৫০টা গান দেন, তাহলে বাকি ৫০টা অন্যদের মধ্যেও ভাগ করে দিতে হবে। প্রত্যেকেরই জীবিকা আছে, জীবন আছে। এটা কেমন কথা যে, সব জায়গায় কেবল একজনেরই নাম থাকবে?”

ওয়াডেকারের এই কথাগুলি সিনেমা জগতে শিল্পীদের নিয়ে ঠিক কতটা রাজনীতি চলে, তা স্পষ্ট করে তুলে ধরেন। তাঁর মতে, বলিউড একটি ‘অশুদ্ধ’ বা ‘অশোধিত’ শিল্পক্ষেত্র। তিনি বলেন, “এখানে এতটাই নেতিবাচকতা রয়েছে যে, যখন ১০০ জনের মধ্যে ৫০ জন আপনাকে অভিশাপ দেবে, তখন সেই অভিশাপের প্রভাব পড়বেই।”
 
মহম্মদ রফির গান রেকর্ড করার একটি মুহূর্ত
 
মোহাম্মদ রফির সঙ্গে সুরেশ ওয়াডেকারের ঘনিষ্ঠতাও কারও কাছে গোপন ছিল না। তিনি বলেন, একবার রফি সাহেবের সঙ্গে তিনি কাওয়ালি গান গেয়েছিলেন। তখন রফি সাহেবের আত্মীয় স্বজন তাঁকে ফোন করে জানিয়েছিলেন যে, রফি সাহেব তাঁর গানে খুবই আবেগপ্রবণ হয়ে পড়েছিলেন। সেই মুহূর্তটি আজও সুরেশ ওয়াডেকারের জীবনে এক গর্বের বিষয়।

ওয়াডেকার অত্যন্ত আবেগভরে বলেন, “রফি সাহেব কেবল একজন গায়ক ছিলেন না, তিনি ছিলেন ঈশ্বরের কণ্ঠ। তাঁর মতো কেউ ছিল না, আর কোনওদিন হবেও না। আমাদের মতো হাজার হাজার গায়ক তাঁর গান শুনে সংগীত শিখেছে।

তাঁর জীবনীতে প্রকাশিত তথ্য অনুযায়ী, মোহাম্মদ রফি গলার রোগে আক্রান্ত হয়েছিলেন। দীর্ঘদিন ধরে তিনি গলার সংক্রমণে ভুগছিলেন। সেই সময়কালে তিনি তুলনামূলকভাবে কিছু কম গান রেকর্ড করেছিলেন। যদিও এই সময়ে তাঁর সংগীতচর্চা কিছুটা কমে গিয়েছিল, তবুও তিনি এই সময়ে কিছু অসাধারণ গান গেয়েছিলেন।

১৯৮০ সালের ৩১ জুলাই হৃদরোগে আক্রান্ত হয়ে মাত্র ৫৫ বছর বয়সে মোহাম্মদ রফির মৃত্যু হয়। তিনি মূলত হিন্দি ছাড়াও বিভিন্ন ভারতীয় ও বিদেশি ভাষায় ২৫ হাজারেরও বেশি গান রেকর্ড করেছিলেন।

২০০১ সালে হিরো হোন্ডা ও স্টারডাস্ট ম্যাগাজিন তাঁকে "সহস্রাব্দের শ্রেষ্ঠ গায়ক" হিসেবে নির্বাচিত করে। জুহুর মুসলিম কবরস্থানে তাঁকে সমাধিস্থ করা হয় এবং সেখানে ১০ হাজারেরও বেশি মানুষ উপস্থিত ছিলেন। সেই কারণেই তাঁর অন্ত্যেষ্টিক্রিয়াকে ভারতের অন্যতম বৃহৎ শোকযাত্রা হিসেবে বিবেচনা করা হয়।
 
স্ত্রী বিলকিস রফির সাথে মোহাম্মদ রফি
 
ভারত সরকার তাঁর সম্মানে দু’দিনব্যাপী জাতীয় শোক ঘোষণা করেছিল। প্রখ্যাত প্রযোজক-পরিচালক মনমোহন দেশাই (যিনি রফির বড় অনুরাগী ছিলেন) এবং যিনি তাঁকে অসংখ্য হিট ছবিতে ব্যবহার করেছিলেন, যখন তাঁকে রফির কণ্ঠ সম্পর্কে মন্তব্য করতে বলা হয়, তখন তিনি বলেছিলেন, “যদি কারও কণ্ঠে ঈশ্বরের সুর থাকে, তবে তা মোহাম্মদ রফির কণ্ঠেই রয়েছে।”

 মোহাম্মদ রফিকে শ্রদ্ধার সঙ্গে স্মরণ করতে গিয়ে একটিই প্রশ্ন মনে জাগে এ কি সেই দেশ, যেখানে ‘ঈশ্বরের কণ্ঠ’-কেও বছরের পর বছর নীরব করে রাখা হয়েছিল? রফি সাহেবের কণ্ঠ আজও প্রতিটি হৃদয়ে, প্রতিটি গানে অনুরণিত হয়। তবে এই স্মৃতি চিরকাল জিইয়ে রাখা উচিত। যে শিল্প ও শিল্পীকে নীরব করে দেওয়া, যেকোনো সভ্যতার সবচেয়ে বড় অন্যায়।