দেবকিশোর চক্রবর্তী, বীরভূম
শরৎশেষের নিশীথে যখন চারিদিকে দীপাবলির আলো ঝলমল করে, তখন বাংলার নানা প্রান্তে মাতৃ আরাধনার মহোৎসবে মেতে ওঠে মানুষ। আর সেই উৎসবের এক বিশেষ কেন্দ্র বীরভূম জেলার সতীপীঠ কঙ্কালীতলা। ত্রিসন্ধ্যা নদীর তীরে অবস্থিত এই শক্তিক্ষেত্রটি দেবী উপাসনার অন্যতম পবিত্র স্থান হিসেবে খ্যাত। বিশ্বাস করা হয়, এখানে সতীদেবীর কঙ্কাল বা কোমরদেশ পতিত হয়েছিল, তাই এর নাম “কঙ্কালীতলা”। কালীপুজোর রাতে এই স্থান পরিণত হয় ভক্তির আগুনে জ্বলন্ত এক আধ্যাত্মিক প্রান্তরে।
শক্তিপীঠের মাহাত্ম্য
পুরাণ অনুযায়ী, ভগবান শিবের বুকে সতীদেবীর দেহখণ্ড বহনের সময় যেসব স্থানে তাঁর অঙ্গ পতিত হয়, সেগুলিই শক্তিপীঠ রূপে পূজিত। কঙ্কালীতলা সেই ৫১টি পীঠের একটি। এখানে দেবী পূজিত হন কঙ্কালেশ্বরী নামে এবং ভৈরব রূপে উপস্থিত আছেন রূরুভৈরব। মন্দির চত্বরে দেবীর মূর্তি নয়, বরং একটি চিত্ররূপে দেবী পূজিত হন—যা এই পীঠের অন্যতম বৈশিষ্ট্য।
দীপাবলির রাত্রেই এখানে কালীপুজোর বিশেষ আয়োজন হয়। আশ্বিনী বা কার্তিক অমাবস্যার রাতেই ভক্তরা দূরদূরান্ত থেকে এসে জড়ো হন। সন্ধ্যা নামার সঙ্গে সঙ্গে মন্দির প্রাঙ্গণ ভরে ওঠে ধূপ-ধুনো আর শাঁখধ্বনিতে। পুজো শুরু হয় তান্ত্রিক রীতিতে—অগ্নিসংস্কার, বীজমন্ত্রোচ্চারণ, আর মাতৃস্তব পাঠের মধ্য দিয়ে। স্থানীয় তান্ত্রিক পুরোহিতদের মতে, “এই রাতে কঙ্কালেশ্বরী মাতার আরাধনায় সকল বাধা দূর হয়, আর ভক্তের মনোবাসনা পূর্ণ হয়।”
রাতভর চলে দেবীর মহানিশা পূজা। ভোর পর্যন্ত মন্দির চত্বরে ধ্বনিত হয় জয় মা কালী উচ্চারণ। এই পীঠের অন্যতম বিশেষতা হল আমিষ ভোগ নিবেদন। প্রাচীন তান্ত্রিক প্রথা অনুসারে, এখানে মদ-মাংস ও চালের ভোগ মাতাকে নিবেদন করা হয়। পূজার পর সেই ভোগ ভক্তদের মধ্যে প্রসাদরূপে বিতরণ করা হয়। অনেকে বিশ্বাস করেন, এই ভোগ গ্রহণে জীবনের পাপমোচন ঘটে।
কালীপুজোর দিনে কঙ্কালীতলায় হাজার হাজার মানুষ ভিড় করেন। কেউ প্রণাম দিতে আসেন, কেউ বা মানত পূর্ণ করতে। অনেকে সারা বছর ধরে এই পবিত্র রাতে হাজির হন মাতার চরণে। মন্দিরের আশপাশে বসে মেলা, চলে ভক্তিমূলক গান, বাজে ঢাক ও কাঁসার ঘন্টা। স্থানীয় বাসিন্দা কৃষ্ণপদ ঘোষ বলেন, “এই রাতে কঙ্কালীতলায় এমন এক পরিবেশ সৃষ্টি হয়, যেন স্বয়ং মা কালী নেমে এসেছেন ভক্তদের আশীর্বাদ দিতে।”
কঙ্কালীতলার কালীপুজো শুধু ধর্মীয় নয়, সাংস্কৃতিক ভাবেও এক মিলনমেলা। লোকনৃত্য, বাউলগান, ঢাকের প্রতিযোগিতা—সব মিলিয়ে এই সতীপীঠ পরিণত হয় এক অনন্য উত্সবে। জেলা প্রশাসন ও স্থানীয় কমিটি যৌথভাবে নিরাপত্তা ও শৃঙ্খলার ব্যবস্থা করে।
আলোকিত অমাবস্যার সেই রাত্রি যখন ভক্তরা মাতৃচরণে নিজেদের সমস্ত দুঃখ-আশা সমর্পণ করেন, তখন কঙ্কালীতলার বাতাস ভরে ওঠে ভক্তির স্পন্দনে। কালীপুজোর এই মহারাত্রি শুধু এক ধর্মীয় আচার নয়, বরং বাংলার লোকবিশ্বাস, তান্ত্রিক সংস্কৃতি ও আধ্যাত্মিক ঐতিহ্যের এক জীবন্ত নিদর্শন।