মালিক আসগর হাশমী
কিছুদিন আগে হয়তো অনেকেই রাশিয়ার রাষ্ট্রপতি ভ্লাদিমির পুতিন মুসলমানদের শুভেচ্ছা জানানো একটি ভিডিও প্রত্যক্ষ করেছিলেন। পশ্চিমা সংবাদমাধ্যমে রাশিয়াকে প্রায়ই ডানপন্থী বা রক্ষণশীল দেশ হিসেবে গণ্য করা হয়। তাই অনেকেরই মনে প্রশ্ন জাগতে পারে, সেখানে ইসলামের অবস্থান কী? কিন্তু বাস্তবে রাশিয়ার পরিস্থিতি চীন বা জাপানের মতো নয়, যেখানে মুসলমানদের সংখ্যা কম বা কঠোর নীতি প্রয়োগ করা হয়। রাশিয়া শুধু ঐতিহাসিকভাবে ইসলামের সঙ্গে যুক্ত নয়, বরং আজ সেখানে খ্রিস্ট ধর্মের পর ইসলাম দেশটির দ্বিতীয় বৃহত্তম ধর্ম।
শুধু তাই নয়, ভারতসহ বহু মুসলিম দেশের সঙ্গেও পুতিনের সৌহার্দ্যপূর্ণ সম্পর্ক রয়েছে এবং গাজার ওপর ইসরাইলের বোমাবর্ষণের সময় প্রতিবাদ করা কয়েকটি দেশের মধ্যে রাশিয়া ও পুতিনও ছিলেন। যা তার আন্তর্জাতিক নীতির ভারসাম্যকে প্রতিফলিত করে। রাশিয়ায় মুসলমানরা কোনো ভয় বা আতঙ্ক ছাড়াই ধর্মীয় স্বাধীনতা উপভোগ করে। কিন্তু এই জনসংখ্যা বৃদ্ধি এবং ধর্মীয় স্বাধীনতার বিপরীতে রাশিয়ার কারাগারগুলোর অন্ধকার বাস্তবতার সঙ্গে এক তীব্র বৈপরীত্য বিদ্যমান।
রাশিয়ায় মুসলমানদের নামাজ পড়ার একটি দৃশ্য
রাশিয়ায় ইসলামের ইতিহাস বহু শতাব্দী পুরোনো। ইসলাম ও রাশিয়ার প্রথম যোগাযোগ ঘটে মধ্যযুগে। মুসলিম বণিক ও দূতেরা ইসলামকে রাশিয়ায় নিয়ে আসে এবং হিজরি ১৮ সালে ইসলাম প্রথম পূর্ব ককেশাস অঞ্চলে (আজারবাইজান) প্রবেশ করে। হিজরি ৩৮ সালের মধ্যে ইসলাম গোটা ককেশাস অঞ্চলে প্রতিষ্ঠিত হয়। সময়ের সঙ্গে রাশিয়ার অভ্যন্তরে ইসলামিক দেশসমূহের প্রসার ঘটে এবং মুসলমানদের সংখ্যা, সংগঠন এবং ধর্মীয় আচারের শক্তি ক্রমশ বৃদ্ধি পায়।
আজ ইসলাম রাশিয়ার দ্বিতীয় বৃহত্তম ধর্ম, যার অনুসারী প্রায় ২.৬ কোটি, মোট জনসংখ্যার প্রায় ১৫%। অনুমান করা হচ্ছে ২০৫০ সালের মধ্যে রাশিয়ার এক-তৃতীয়াংশ মানুষ মুসলমান হবে, ফলে এটা দেশটির দ্রুততম বৃদ্ধি পাওয়া সম্প্রদায় হিসেবে উঠে আসবে।
রাশিয়ার বেশিরভাগ মুসলমান উত্তর ককেশাস, তাতারস্থান, বাশকোর্তোস্তান অঞ্চল এবং রাজধানী মস্কোতে বসবাস করে। একসময়ের ছোট মস্কো আজ ইউরোপের অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ শহরে পরিণত হয়েছে। এর মোট ১.৫ কোটি জনসংখ্যার মধ্যে প্রায় ২৫ লক্ষ মুসলিম। বর্তমানে মস্কোর রাস্তায় প্রতি চারজনের একজন মুসলমান এবং শহরে ৬টি বড় মসজিদ ও ২০টিরও বেশি ছোট মসজিদ রয়েছে।
রাশিয়ার একটি মসজিদ
রাশিয়ার মুসলিমরা ধর্মীয় রীতি অনুসারে অনুশীলন করে এবং রমজান মাসে আয়োজিত সামাজিক কর্মসূচিতে অংশগ্রহণের স্বাধীনতা ভোগ করে। রমজানে সাধারণ মানুষের জন্য প্রকাশ্যে ইফতারের ব্যবস্থাও থাকে। বহুসাংস্কৃতিক সমাজে শান্তিপূর্ণ সহাবস্থানের লক্ষ্যে মুসলিম ও অমুসলিমদের যৌথ অংশগ্রহণে বিভিন্ন অনুষ্ঠানের আয়োজন করা হয়। রমজান উপলক্ষে শহরগুলো সুন্দর আলোকসজ্জায় সজ্জিত হয় এবং নানা আয়োজন চলে। রাশিয়ার মুফতিয়াত রমজানের জন্য বিশেষ কর্মসূচি তৈরি করে, দরিদ্র, অনাথ, বিধবা ও অসহায়দের তালিকা প্রস্তুত করে আর্থিক ও খাদ্য সাহায্য প্রদান করে।
"মস্কোর রমজানের তাঁবু" এই পবিত্র মাসের একটি প্রধান আকর্ষণ। ২০০৬ সাল থেকে প্রতি বছর মধ্য মস্কোর পোক্’লোনায়া গোরার স্মারক মসজিদের চত্বরে অনুষ্ঠিত হয় এবং রমজান মাসে এখানে ৪৫,০০০-এরও বেশি দর্শনার্থী একত্রিত হন।
কিন্তু বৃদ্ধি পাওয়া ইসলামিক জনসংখ্যা এবং ধর্মীয় স্বাধীনতার এই দৃশ্য অন্য দিক থেকে একটি অন্ধকার বাস্তবতা আড়াল করে রেখেছে, তা হলো রাশিয়ার কারাগারে থাকা মুসলমানদের সংগ্রাম। প্রায় একশো বছর ধরে সোভিয়েত ও রাশিয়ার কারাগারগুলোকে অলিখিত আইনে শাসিত এক নিষ্ঠুর ও অন্ধকার জগত হিসেবে বর্ণনা করা হয়ে আসছে। সেখানে হাজার হাজার মুসলিম বন্দি ধর্ম পালনের জন্য প্রতিনিয়ত বাধার মুখে পড়ছে।
২০২৩ সালের নভেম্বরে সাইবেরিয়ার একটি তীব্র ঠান্ডার কারাগারে পাঠানো ক্রিমিয়ান নেতা নারিমান দজেলিয়ালের অভিজ্ঞতা এই বাস্তবতাকে উন্মোচিত করেছে। তার কথায়, একজন ধর্মপ্রাণ মুসলমান হিসেবে তাকে যে খাদ্য দেওয়া হত তার বেশিরভাগই ছিল শুকরের মাংস, যা ইসলামে নিষিদ্ধ।
রাশিয়ান মুসলমানদের একটি জানাজা অনুষ্ঠানের দৃশ্য
তিনি বহুদিন ধরে শুধু রুটি ও চা খেয়ে বেঁচেছিলেন। খাদ্য সমস্যার বাইরেও আরও বড় সমস্যা ছিল, রাশিয়ার কারাগারের নিয়মের কারণে প্রায় হাজার হাজার বন্দি ফজর ও ইশার নামাজ আদায় করতে পারতো না, কারণ রাত ১০টা থেকে সকাল ৬টা পর্যন্ত বিছানা ছেড়ে ওঠা বা খাবার খাওয়া নিষিদ্ধ ছিল। ফলে রমজানে রোজা রাখা অনেক বন্দির জন্য অত্যন্ত কঠিন হয়ে পড়ে।
রাশিয়ার গ্র্যান্ড মুফতি আলবির ক্রগানভের মতে, ২০২৪ সালের নভেম্বর পর্যন্ত রাশিয়ার মোট ২,০৬,০০০ বন্দির মধ্যে প্রায় ৩১,০০০ জন মুসলিম, যা মোট বন্দির প্রায় ১৫%। আরও উদ্বেগজনক বিষয় হলো, মানবাধিকার সংগঠন ও গণমাধ্যমের প্রতিবেদন অনুযায়ী ইসলাম ধর্ম গ্রহণ করা রুশ বন্দিদের "স্বয়ংক্রিয়ভাবে" সন্ত্রাসবাদের সন্দেহভাজন তালিকায় অন্তর্ভুক্ত করা হয় এবং অনেক ক্ষেত্রে "উগ্রবাদ"র অভিযোগে তাদের কারাদণ্ডও বাড়িয়ে দেওয়া হয়।
ফেডারেল সার্ভিস ফর এক্সিকিউশন অব পানিশমেন্টের প্রাক্তন বিশ্লেষক আন্না কারেতনিকোভা জানিয়েছেন, কোনো বন্দি যদি অর্থডক্স খ্রিস্ট ধর্ম গ্রহণ করে বাপ্তিস্ম নেন তাকে প্রশংসা করা হয়। কিন্তু কেউ যদি ইসলাম গ্রহণ করেন, তাকে তৎক্ষণাৎ উগ্রপন্থী সন্দেহভাজন হিসেবে চিহ্নিত করা হয় এবং গোয়েন্দা বিভাগ তার ওপর বিশেষ নজরদারি শুরু করে।
রাশিয়ার মুসলিম নেতারা
মধ্য এশিয়া থেকে কাজের উদ্দেশ্যে রাশিয়ায় আসা মুসলিম শ্রমিকরা রুশ ভাষা, আইন এবং সামাজিক কাঠামো সম্পর্কে অজ্ঞ হওয়ার কারণে প্রায়ই অপরাধমূলক অভিযোগে জড়িয়ে পড়ে। মানবাধিকার সংগঠনগুলো অভিযোগ করে, পুলিশ ও তদন্তকারী সংস্থাগুলো প্রায়ই তাদের লক্ষ্য করে এবং অন্যের অপরাধের দায় তাদের ওপর চাপিয়ে দেয়।
২০০০-এর দশকের গোড়ায় দ্বিতীয় চেচনিয়া যুদ্ধের পর রাশিয়ার কারাগারে মুসলমানের সংখ্যা দ্রুত বাড়তে শুরু করে। যখন ক্রেমলিন উত্তর ককেশাস, বিশেষত দাগেস্তানে উগ্রবাদ দমনে কঠোর অভিযান চালায়। বিশ্লেষক কারেতনিকোভার মতে, কয়েক দশক পেরিয়ে গেলেও রাশিয়ার প্রশাসন ও কারাগার কর্তৃপক্ষ এই পরিস্থিতির কোনো সমাধান খুঁজে পায়নি এবং কোনো সুনির্দিষ্ট নীতি তৈরি করতেও ব্যর্থ হয়েছে।
সংক্ষেপে বলা যায়, ইতিহাস, জনসংখ্যাগত বাস্তবতা এবং আন্তর্জাতিক কূটনীতির প্রেক্ষাপটে ইসলাম রাশিয়ার একটি দৃঢ় ও বিস্তৃত শক্তি। যেখানে মুসলমানরা ধর্মীয় স্বাধীনতা উপভোগ করে, যার প্রমাণ মস্কোর জনজীবন ও রমজান তাঁবুর মতো কর্মসূচি। কিন্তু দেশটির কারাগার ব্যবস্থায় হাজারো মুসলিম বন্দির সংগ্রাম ও ধর্মান্তরিত মুসলমানদের প্রতি প্রশাসনিক সন্দেহ, রাশিয়ায় ইসলামের এক জটিল, দ্বিমুখী এবং বৈপরীত্যপূর্ণ চিত্রই তুলে ধরে।