মালিক আসগর হাশমী
কিছু স্মৃতি কখনও মুছে যায় না। ঠিক তেমনই এক স্মৃতি হলো উত্তর প্রদেশের আলিগড়ে একটি স্থানীয় ভাষার সংবাদপত্র ‘অমর উজালা’-র সংবাদ সম্পাদক হিসেবে আমার কাজের দিনগুলোর। আমি তখন আলিগড়ে থাকতাম এবং আমার স্ত্রী ও দুই সন্তান হরিয়ানার গুরুগ্রামে ছিলেন।
একটি ব্যস্ত শহরে একটি সংস্করণের দায়িত্বে থাকা মানে ছিল, জীবন সংবাদেই আবদ্ধ। আমার কাজ সকাল থেকে গভীর রাত পর্যন্ত চলত। কাগজের পৃষ্ঠার কাজ শেষ হওয়ার পরও দিনের ঘটনাগুলো আমার মনের মধ্যে তাজা থাকত। প্রায়ই ভোর ৩টায় আমি অফিস ছাড়তাম।
Unforgettable experiences
একদিন গভীর রাতে, পরের দিনের সংবাদপত্রের শিরোনাম চূড়ান্ত করার সময় আমার ফোন বেজে উঠল। ভোর প্রায় ২টা ৩০ মিনিটে আমার স্ত্রীর ফোন করা অস্বাভাবিক ছিল। ওর আতঙ্কিত, কাঁপা কণ্ঠস্বর আমাকে উৎকণ্ঠায় ফেলে দিল। হাঁপাতে হাঁপাতে সে বলল, “পুলিশ আমাদের বড় ছেলেকে ৫ নম্বর সেক্টরের থানায় নিয়ে গেছে।”
রোগা চেহারার আমার ছেলে সালিক তখন নবম শ্রেণির ছাত্র। স্ত্রীর ফোন পেয়ে আমার মাথায় যেন বাজ পড়ল। রাতের অন্ধকারে পুলিশ আমার সন্তানকে বাড়ি থেকে তুলে নিয়ে গেছে! সে কী করেছে? কেমন আছে? এইসব ভাবতে ভাবতে আমার শরীর শীতল হয়ে গেল। আমার দুশ্চিন্তা বুঝে স্ত্রী বলল, “মায়াঙ্কের সঙ্গে কথা বলো… সে এখনই সালিককে থানায় নিয়ে যাবে।”
মায়াঙ্ক তিওয়ারি আমার পুরনো সহকর্মী, গুরুগ্রামের একজন উজ্জ্বল সাংবাদিক। এই নামটি শুনেই আমার কিছুটা স্থিরতা ফিরল। আমি গভীর শ্বাস নিয়ে জিজ্ঞেস করলাম, “সালিকের কী হয়েছে? পুলিশ কেন তাকে নিয়ে গেল?” স্ত্রী কষ্টে কাঁপা গলায় ঘটনাটি বলল, “সালিক কোনো ভুল করেনি। একজন চোর বাড়িতে ঢুকেছিল। প্রতিবেশীরা চোরটিকে ধরে পুলিশে দেয়। পুলিশ সাক্ষী হিসেবে সালিককে থানায় নিয়ে গেছে।”
আমি গুরুগ্রামের একটি সমৃদ্ধ এলাকায় থাকি, যেখানে অধিকাংশই পেশাদার মানুষ। ১০ হাজার জনের মধ্যে মুসলিম পরিবার মাত্র পাঁচটি, আর আমাদের ঘনিষ্ঠ প্রতিবেশী মুসলমান ছিলই না। আমাদের বাড়ির সামনে এক খ্রিস্টান পরিবার, পাশে এক ওড়িয়া ব্রাহ্মণ পরিবার ও অন্যদিকে শর্মাজির পরিবার, তারা পাঞ্জাবি। শর্মাজির ভাড়াঘরে একটি শিখ পরিবার থাকত। সবাই কর্মজীবী, ব্যস্ত মানুষ।
স্ত্রী লাজুক ও আতঙ্কিত কণ্ঠে সেদিন রাতের দৃশ্যটি ফোনে বিস্তারিত বলেছিল, সেদিন রাতে স্ত্রী ও দুই সন্তান ঘুমিয়ে ছিল। আমাদের বাড়ি থেকে দু’ঘর দূরে এক যুবক থাকে, কল সেন্টারে কাজ করে। কাজ থেকে দেরি করে ফিরে ছাদে বিশ্রাম নিতে গিয়ে সে একজন অচেনা মানুষকে দেয়াল টপকে আমাদের বাড়ির ছাদে ঢুকতে দেখেছিল।
সে মুহূর্তে বুঝে যায় যে লোকটি অচেনা এবং নিশ্চয়ই খারাপ উদ্দেশ্যে ঢুকেছে। সে সঙ্গে সঙ্গে বাড়ির মালিক ফুলচাঁদকে খবর দেয়। ফুলচাঁদ এবং প্রতিবেশীরা জানতেন যে আমি আলিগড়ে থাকি এবং স্ত্রী ও দুই সন্তান একা থাকে।
কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা দ্বারা নির্মিত ঘটনাটির একটি ছবি
পরিবারকে নিরাপদ রাখার দৃঢ় সংকল্পে ফুলচাঁদের চোখ রাগে জ্বলে ওঠে। এক মুহূর্ত দেরি না করে তিনি পরিবারের সব পুরুষ সদস্যকে জাগিয়ে তুললেন; সবাই লাঠি হাতে নিল। এরপর তারা আশেপাশের অন্য প্রতিবেশীদের ডাকলেন।
ডোরবেল বাজতেই স্ত্রী দরজা খুলল, বাইরে ১০–১২ জন লোক লাঠি হাতে দাঁড়িয়ে! স্ত্রী প্রথমে ভেবেছিল আমি হঠাৎ আলিগড় থেকে ফিরে এসেছি। কিন্তু যখন প্রথম তলার বারান্দা থেকে নিচে তাকাল, সে স্তব্ধ হয়ে গেল।
মূল গেটের সামনে লাঠি হাতে দাঁড়িয়ে এতজন মানুষ, তার বুক প্রায় থমকে গিয়েছিল। সাম্প্রদায়িক উত্তেজনার খবর তখন খুব সাধারণ ঘটনা ছিল। কিছুদিন আগেই সে শুনেছিল রাস্তায় নামাজ নিয়ে বিতর্কে মারামারি হয়েছে, “জয় শ্রীরাম” না বলায় টুপি পরা একজন মানুষকে মারধর করা হয়েছে। এসব স্মৃতি তাকে ভয় আর অবিশ্বাসে আচ্ছন্ন করে ফেলেছিল। স্ত্রীর মনে হলো, আজ হয়তো আমাদের পরিবারের ওপরও আক্রমণের পালা এসেছে। হিন্দু প্রতিবেশীরা হয়তো মুসলিম পরিবার হিসেবে আমাদের ওপর হামলা করবে!
ঠিক সেই মুহূর্তে অন্ধকারের ভিতর দিয়ে ফুলচাঁদের দৃঢ়, উচ্চ স্বর শোনা গেল, “ভাবিজি, ভয় পাবেন না। তাড়াতাড়ি দরজা খুলুন। আপনার বাড়ির ছাদে একজন চোর আছে।”
এই কথাটি শুনে স্ত্রী যেন বিভ্রান্তির জগৎ থেকে বাস্তবে ফিরে আসে। সঙ্গে সঙ্গে দরজা খুলতে নিচে নেমে যায়। মুহূর্তেই তলা ভরে গেল প্রতিবেশীদের ভিড়ে। কয়েকজন ছাদে গিয়ে সত্যিই এক অচেনা মানুষকে দেয়ালের পাশে গুটিসুটি মেরে লুকিয়ে থাকতে দেখল।
কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা দ্বারা নির্মিত ঘটনাটির একটি ছবি
লোকজন চোরটিকে রাস্তায় নামিয়ে আনে এবং প্রহৃত করে। অল্প সময়ের মধ্যেই পুলিশ এসে তাকে নিয়ে যায় এবং সাক্ষী হিসেবে সালিককে থানায় যেতে বলে। আমি এরপর মায়াঙ্ক তিওয়ারিকে ফোন করলাম। তিনি ঘটনাটি শুনে বললেন, “আসগর ভাই, চিন্তা কোরো না। আমি এখনই থানায় যাচ্ছি।”
কিছু সময় পরে স্ত্রী আবার ফোন করল, এইবার স্বর ছিল শান্ত। সে বলল, “মায়াঙ্ক তিওয়ারি সালিককে বাড়ি পৌঁছে দিয়েছে।” তখন ভোর ৫টা ১৫ বাজে। গ্রীষ্মকাল, দিগন্তে উজ্জ্বল সূর্যের আলো ছড়িয়ে পড়ছিল।
আজ যখন হিন্দু ও মুসলমানদের মধ্যে মতবিরোধ দেখি, অবিশ্বাস দেখি, তখনই সেই সকালটা মনে পড়ে যায়। দিগন্তের সেই লাল ভোর শুধু প্রকৃতির রঙ ছিল না, প্রতিবেশীদের ভালোবাসা, মানবতার আলোয় উদ্ভাসিত এক ভোর ছিল।
আমার অনুপস্থিতিতে আমার সমস্ত হিন্দু প্রতিবেশীরা একজন মুসলিম পরিবারকে রক্ষা করতে নিজেদের জীবনকেও তুচ্ছজ্ঞান করেছিলেন। এই ঘটনাটি আমার কাছে সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতির যে কোনও গ্রন্থের চেয়েও মূল্যবান। আমার অনুপস্থিতিতে প্রতিবেশীরা শুধু আমার পরিবারকে সুরক্ষা দিয়েছিল তা নয়, বরং অস্ত্র নিয়ে আক্রমণ করতে প্রস্তুত থাকতে পারে, এমন একজন চোরকে ধরতে নিজেদের জীবনকেও বিপদের মুখে ঠেলে দিয়েছিল।
এই ঘটনাটি আমার কাছে সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতির যে কোনও বইয়ের চেয়েও মূল্যবান। সংকটের সময় মানুষ আসল পরিচয় প্রমাণ করে, ধর্ম নয়, মানবতা-ই তখন প্রতিবেশীর ধর্ম হয়ে ওঠে। উপলব্ধি ও বাস্তবের ফারাক বোঝাতে আমি এই গল্পটি সবার জন্য লিখলাম।
পাঠকরাও তাঁদের সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি বা আন্তঃধর্মীয় বন্ধুত্বের অভিজ্ঞতা [email protected]–এ পাঠাতে পারেন প্রকাশের জন্য- সম্পাদক।