মন্দিরে দুই মুসলিম, খুঁজে পেল সত্যিকারের ভারত

Story by  atv | Posted by  Aparna Das • 5 h ago
AI দ্বারা প্রস্তুত করা ছবি
AI দ্বারা প্রস্তুত করা ছবি
 
আসার আলম / নয়া দিল্লি

পাঁচ বছর আগে নয়া দিল্লির জামিয়া মিলিয়া ইসলামিয়ায় স্নাতক ডিগ্রির পড়াশোনার সময়কার কথা, কলেজে বন্ধ থাকার অল্প সময়টুকু কাজে লাগিয়ে আমি রাজস্থান ভ্রমণে বেরিয়ে পড়েছিলাম। মাত্র দুদিন ছুটি ছিল, সেই দুদিনের সময়কে কাজে লাগিয়ে ব্যাগ গুছিয়ে যে প্রথম বাসটি জয়পুরের উদ্দেশ্যে যাচ্ছিল, তাতে উঠে পড়েছিলাম।
 
আমাকে রাজস্থানে নিয়ে যাওয়ার মূল অনুপ্রেরণা ছিলেন আমার বন্ধু আরশাদ সাবরী। সে সময় তিনি জয়পুরেই থাকতেন। আমি ছুটির খবর দেওয়ার সাথে সাথেই তিনি আমাকে আর বিশ্রাম নিতে দিলেন না। অত্যন্ত আন্তরিকভাবে বলেছিলেন, “ভাই, কালই তোমাকে জয়পুরে আসতে হবে।”
 
Unforgettable experiences 
 
তার কথামতো পরদিনই আমি জয়পুরে পৌঁছালাম। আমরা একসাথে রাজস্থানের শহরগুলোর অনেক জায়গা ঘুরলাম, শহরের জাঁকজমক, সংস্কৃতি, ঐতিহ্য এবং মানুষের জীবনযাপনকে খুব কাছ থেকে দেখলাম। কিন্তু সবচেয়ে বেশি আমাকে ছুঁয়ে গিয়েছিল, সেই সব মন্দিরে কাটানো মুহূর্তগুলো।
 
আমরা দুজনই মুসলমান ছেলে হলেও সেই পবিত্র মন্দিরগুলোর ভেতরে আমরা সবসময় অদ্ভুত শান্তি অনুভব করেছি। ঘণ্টার পর ঘণ্টা নীরবে বসে আমরা চারপাশের নিস্তব্ধতা ও আধ্যাত্মিক অনুভব উপভোগ করতাম। মন্দিরের পুরোহিতরা কৌতূহলী ও হাসিমুখে আমাদের সঙ্গে কথা বলতেন। সেখানে আমরা সম্পূর্ণ পরিবারবৎসল ভালোবাসা অনুভব করেছিলাম। মন্দিরের ভেতরে আমাদের দেখে তাঁদের যে আনন্দ প্রকাশ পেয়েছিল, তা যেন একটি মহান সত্যকে স্মরণ করিয়ে দিচ্ছিল, যখন হৃদয় উন্মুক্ত থাকে, তখন বিশ্বাস মানুষকে বিভক্ত নয় বরং এক করে।
 

আমার জীবনের সবচেয়ে স্মরণীয় মুহূর্তগুলোর একটি ছিল পুষ্কর ভ্রমণ, যেখানে আমরা প্রবেশ করেছিলাম বিখ্যাত ব্রহ্মা মন্দিরে, (বিশ্বের একমাত্র ব্রহ্মমন্দির)। একজন প্রবীণ পুরোহিত আমাদের অনেকদিনের পরিচিত বন্ধুর মতো সাদরে অভ্যর্থনা করেছিলেন। বসতে দিয়েছিলেন, এবং অত্যন্ত নম্রতায় আড্ডায় মেতে উঠেছিলেন। সেই মুহূর্তে আমরা যেন হঠাৎ করে বাড়ির মানুষ হয়ে গিয়েছিলাম।
 
কিছুক্ষণ অর্থবহ আলাপের পর তিনি আমাদের প্রসাদ দিয়েছিলেন। মন্দির ছাড়ার সময় তিনি বলেছিলেন,
“এটাই ভারত, আর এটাই আমাদের সংস্কৃতি।” এই বাক্যটি আমার মনে চিরদিনের জন্য খোদাই হয়ে রইল। এটাই আমাদের সামাজিক জীবন, ধর্ম ছাড়িয়ে ভালোবাসা ভাগ করে নেওয়া। এই মনোভাবই আমাদের দেশকে আরও সুন্দর করে তোলে।
 
তার কণ্ঠে আবেগ ছিল এবং কথায় ছিল গভীর বাস্তবতা। আজও সেই মুহূর্তগুলোর কথা ভাবলে দেশের বৈচিত্র্যের জন্য আমার হৃদয় গর্বে ভরে ওঠে। আমরা এমন এক দেশে থাকি যেখানে ভালোবাসা সবচেয়ে বড় শক্তি।
 
আরেকটি স্মরণীয় ঘটনা ছিল জয়পুর শহরের নির্জন পাহাড়ের ওপর থাকা ‘গলতা ধাম’ মন্দিরে। সন্ধ্যার দিকে আমি ও বন্ধু সেখানে উঠেছিলাম। কিছুক্ষণ বসে সূর্যাস্ত দেখছিলাম। দৃশ্যটি ছিল জাদুকরী, আকাশের নিচে জয়পুর উজ্জ্বল হয়ে উঠছিল এবং আমরা একে অন্যকে বলছিলাম, “বন্ধু, এই শহরটা সত্যিই অপূর্ব।”
 
AI দ্বারা প্রস্তুত করা ছবি
 
কয়েকদিন আমাদের লক্ষ্য করার পর একদিন মন্দিরের পুরোহিত আমাদের কাছে ডাকলেন। মৃদু হাসি দিয়ে জিজ্ঞেস করলেন, “তোমরা কি প্রতিদিন এখানে আসো? জায়গাটা সুন্দর লাগে?” আমরা বললাম, “পূজারীজী, জায়গাটা সত্যিই অপূর্ব, আর পাহাড়ের শীর্ষে থাকা এই মন্দিরটি এর সৌন্দর্য আরও বাড়িয়ে দিয়েছে।”
 
তিনি আবার হাসলেন। কিছুক্ষণ পরে তিনি শান্তভাবে জিজ্ঞেস করলেন, “তোমরা কি দুজন মুসলমান?” আমরা একটুও দেরি না করে মাথা নাড়লাম। তারপর তিনি স্নেহভরে বললেন, “তোমাদের ভক্তি দেখে খুব আনন্দ পেলাম। তোমরা সংস্কৃতিমনা সন্তান। তোমাদের হৃদয়ে ভারতের সত্যিকারের রং প্রতিফলিত হয়েছে।”
 
আমরা আপ্লুত হয়ে পড়েছিলাম। এরপর তিনি খাবার দিতে চাইলেও আমরা দুপুরে খেয়ে যাওয়ার কারণে বিনয়ের সাথে অস্বীকার করে কিছু প্রসাদ চেয়েছিলাম। তিনি আনন্দের সাথে মিঠাই এনে আমাদের আশীর্বাদ করে বললেন, “ভগবান তোমাদের মঙ্গল করুন। সমাজকে তোমাদের মতো যুবকদের কাছ থেকে শেখা উচিত।”
 
এই শব্দগুলো আশীর্বাদের চেয়েও অনেক বড় ছিল, তা ছিল মানবতার আলিঙ্গন। আমরা তাঁর প্রতি সমানভাবে আকৃষ্ট হয়ে বলেছিলাম, তাঁর মতো মানুষরাই আমাদের ভালোবাসা ও সম্মান দিয়ে অনুপ্রাণিত করেন। আমরা তাঁকে বলেছিলাম, তাঁর এই উষ্ণতা ও মানবিকতা আমাদের স্মৃতিতে চিরদিন বেঁচে থাকবে এবং আমরা নিশ্চয়ই এই অভিজ্ঞতা অন্যদের সঙ্গে ভাগ করে নেব।
 
AI দ্বারা প্রস্তুত করা ছবি
 
আজ সেই সব মুহূর্তগুলো মনে করলে আমি কৃতজ্ঞতায় ভরে উঠি যে ভাগ্য আমাকে এমন অভিজ্ঞতা উপহার দিয়েছিল। যখন সমাজে কিছু কণ্ঠ আমাদের বিভাজন করতে চায়, তখন এই স্মৃতিগুলো আমাকে ভারতের মূলমন্ত্র “বৈচিত্র্যের মধ্যেই ঐক্য” স্মরণ করিয়ে দেয়। আমরা এমন এক দেশে থাকি, যেখানে মন্দির ও মসজিদ একসাথে দাঁড়িয়ে থাকে, যেখানে উৎসব সবাই মিলে পালন করা হয়, যেখানে ভালোবাসা সব সীমানা ভেদ করে।
 
রাজস্থানের এই স্মৃতিগুলো শুধুই ব্যক্তিগত নয়, এগুলো ভারতের প্রকৃত সৌন্দর্যের হৃদয়ছোঁয়া উদাহরণ। এমন এক দেশ, যেখানে ধর্মের ওপরে মানুষ মানুষকে আলিঙ্গন করে। এমন এক দেশ, যেখানে কে কোন দেবতা পূজা করে তা নয়, বরং মানুষ মানুষকে ভালোবাসাই মুখ্য। যেখানে বিশ্বাস দেয়াল নয়, সেতু হয়ে ওঠে।
 
যখন পুষ্কর আর গলতা ধামের সেই পুরোহিতদের কথা মনে পড়ে, আমি একই বার্তা প্রচার করতে অনুপ্রাণিত হই, সম্প্রীতি, সম্মান ও ভ্রাতৃত্বের বার্তা। যদি প্রতিটি নাগরিক মানুষকে মানুষ হিসেবে দেখতে শেখে, তবে আমাদের বৈচিত্র্যই আমাদের সবচেয়ে বড় শক্তি হয়ে থাকবে।