আপনি হয়তো বারেবারে আপনার আশপাশের মানুষ বা হোয়াটসঅ্যাপ মেসেজ থেকে এই কথা শুনেছেন যে, মুসলমানরা নাকি চারবারের বেশি বিয়ে করে। তাদের কাছে চারবারের বেশি বিয়ে করা নাকি খুবই সাধারণ ব্যাপার। চা-বাগান থেকে টিভি অনুষ্ঠানের বিতর্ক পর্যন্ত আপনি এই কথাগুলো অগণিতবার শুনেছেন। কিন্তু প্রশ্নটা হল, সত্যিই কি ভারতে মুসলমানদের মধ্যে বহুবিবাহ বা একাধিক বিবাহের প্রবণতা প্রচলিত? নাকি এটাও একটি অপপ্রচার, যা সত্যের চেয়ে বেশি আমাদের কুসংস্কারকে প্রতিফলিত করে?
মুসলিম সমাজে চারবার বিয়ে করাকে প্রচলন হিসেবে ধরা হয়, যা একটি আবেগঘন বিষয় এবং যাকে নিয়ে মানুষ প্রায়ই তথ্যের বদলে পূর্বধারণার ওপর নির্ভর করে এসেছে। প্রথমে একটি মৌলিক কথা স্পষ্ট করে দেওয়া প্রয়োজন, বহুবিবাহ মানে একজন পুরুষের একাধিক স্ত্রী থাকা। কিন্তু ভারতে এর সবচেয়ে নির্ভরযোগ্য তথ্য কোথা থেকে পাওয়া যাবে? এই তথ্য সংগৃহীত হয়েছে সরকারের পরিচালিত বিশাল পরিসরের সমীক্ষা, জাতীয় পরিবার স্বাস্থ্য জরিপ (NFHS) থেকে।
সর্বশেষ জরিপ অর্থাৎ পঞ্চম জাতীয় পরিবার স্বাস্থ্য জরিপ ২০১৯-২১ সালে পরিচালিত হয়েছিল এবং এতে উল্লেখ করা হয়েছে যে, সমগ্র ভারতে মাত্র ১.৪ শতাংশ বিবাহিত মহিলা জানিয়েছেন যে তাদের স্বামীর একাধিক স্ত্রী আছে। এর অর্থ হলো ১০০টি বিবাহের মধ্যে ৯৮/৯৯টি বিবাহ একপত্নীক এবং মাত্র ১/২টি বিবাহ বহুপত্নীক।
এ থেকেই প্রথম প্রশ্নের উত্তর মিলছে যে, বহুবিবাহ ভারতবর্ষে কোনো ব্যাপক প্রচলিত প্রথা নয়, বরং এটি একটি অত্যন্ত ক্ষুদ্র ও সংকুচিত ঘটনা। দ্বিতীয় প্রশ্ন হলো, মুসলমানদের মধ্যে কি একাধিক বিবাহ বা বহুবিবাহের প্রাদুর্ভাব বেশি?
পঞ্চম জাতীয় পরিবার স্বাস্থ্য জরিপের তথ্য অনুসারে ধর্মের ভিত্তিতে মুসলমানরা দেশের সর্বাধিক বহুবিবাহী সম্প্রদায় নয়। ১.৯ শতাংশ মুসলমান মহিলা জানিয়েছেন যে তাদের স্বামীর দ্বিতীয় স্ত্রী আছে। এই শতাংশ হিন্দু মহিলাদের ক্ষেত্রে ১.৩ শতাংশ। অন্যান্য ধর্মে, বিশেষত বহু জনজাতীয়/স্থানীয় পরম্পরায় এই সংখ্যা প্রায় ১.৬ শতাংশ।
এখন দুটি বিষয় বিবেচনা করা দরকার। প্রথমত হিন্দু ও মুসলমানদের মধ্যে বহুবিবাহের হারের পার্থক্য অত্যন্ত কম, ১.৩ শতাংশ বনাম ১.৯ শতাংশ। অর্থাৎ প্রতি ১০০টি মুসলিম দম্পতির মধ্যে হয়তো দুজন পুরুষের দুই বা দুইয়ের বেশি স্ত্রী আছে এবং হিন্দুদের ক্ষেত্রে তা প্রায় একজন থেকে দেড়জন।
দ্বিতীয়ত, হিন্দু জনসংখ্যা মুসলিম জনসংখ্যার চেয়ে প্রায় ৪–৫ গুণ বেশি। তাই শুধুমাত্র সংখ্যার বিচারে একাধিক স্ত্রী থাকা হিন্দু পুরুষের মোট সংখ্যা মুসলমানদের চেয়ে কম হবে, এমন দাবি পরিসংখ্যানগতভাবে ঠিক নয়। বহু বিশ্লেষণ অনুযায়ী, মোট সংখ্যার হিসেবে এই সংখ্যা মুসলমানদের তুলনায় বেশি হয়। সুতরাং মুসলমানরা চারবার বিয়ে করে কিন্তু হিন্দুরা তা করে না, এই দাবি তথ্যের বিরুদ্ধে দাঁড় করানো যায় না।
তৃতীয় প্রশ্নটি হলো, অতীতে মুসলমানদের মধ্যে বহুবিবাহ কি সত্যিই ব্যাপক ছিল? প্রতিটি মুসলমান পুরুষ কি দুইবার, তিনবার বা চারবার বিয়ে করতেন? একটু অতীতে ফিরে গেলে দেখা যায় অনেকেই বলেন, “আগে মুসলমানদের মধ্যে এই প্রথা খুব বেশি প্রচলিত ছিল।”
এন এফ এইচ এস (NFHS)- এর তথ্য অনুযায়ী
১৯৬১ সালের জনগণনায় বহুবিবাহের তথ্য আলাদাভাবে নথিভুক্ত করা হয়েছিল। এবং সেখান থেকে উঠে আসা ছবিটা ছিল আরও বিস্ময়কর। জনগণনার তথ্য অনুসারে জনজাতীয় সম্প্রদায়ের মধ্যে বহুবিবাহ প্রায় ১৫%, বৌদ্ধদের মধ্যে ৭.৯%, জৈনদের মধ্যে ৬–৭%, হিন্দুদের মধ্যে ৫.৮% এবং মুসলমানদের মধ্যে ৫.৭% ছিল।
অর্থাৎ ১৯৬১ সালের জনগণনায় বহুবিবাহে মুসলমানরা তালিকার নিচের দিকে ছিল, যদিও হিন্দুদের তুলনায় সামান্য কম। এখান থেকে অনুমান করা যায়, ইতিহাস কখনোই বলেনি যে “মুসলমানরা সবচেয়ে বেশি বহুবিবাহী ছিল।” ভারতের বিভিন্ন ধর্ম ও সম্প্রদায়ের মধ্যে এই ঘটনা স্পষ্ট ছিল এবং সম্প্রদায়ভেদে হ্রাসের প্রবণতাও তথ্যগুলোতে স্পষ্টভাবে প্রতিফলিত হয়েছিল।
এই প্রশ্নের উত্তরের ভিত্তি নিহিত রয়েছে আরও একটি গুরুত্বপূর্ণ তথ্যে। NFHS-এর পরিসংখ্যান দেখায় যে বহুবিবাহ ধর্মের চেয়ে অঞ্চল ও সম্প্রদায়ের সঙ্গে বেশি সম্পর্কযুক্ত। জনজাতীয় সম্প্রদায়ের মধ্যে বহুবিবাহের অনুপাত সর্বাধিক, NFHS-৫ অনুযায়ী প্রায় ২.৪%। ঐতিহ্যগতভাবে উত্তর-পূর্ব ও জনজাতীয় অঞ্চলে বহুবিবাহের প্রবণতা বেশি দেখা যায়।
এমনকি মুসলমানদের মধ্যেও জাতীয় গড়ের তুলনায় নির্দিষ্ট কয়েকটি রাজ্যে বহুবিবাহের হার বেশি, ওড়িশা (৩.৯%), বিহার (২.২%), ঝাড়খণ্ড (২.৪%), পশ্চিমবঙ্গ (২.৮%), অসম (৩.৬%), এবং কর্ণাটক (২.৬%)। সুতরাং শুধুমাত্র মুসলমানদের টার্গেট করে বহুবিবাহের আলোচনা করা বাস্তবসম্মত নয়। যদি একাধিক বিবাহের প্রসঙ্গে কাউকে টার্গেট করতেই হয়, তবে তা শুধু মুসলিমদের ক্ষেত্রে হওয়া উচিত না। তবে প্রশ্ন ওঠে, শুধু মুসলমানদের ক্ষেত্রেই এই আন্দোলন কেন?
যাই হোক, এবার আইনগত কাঠামোটি একটু বোঝা দরকার, কারণ এখান থেকেই বিভ্রান্তির শুরু হয়। ১৯৫৫ সালের হিন্দু বিবাহ আইনের অধীনে হিন্দু, বৌদ্ধ, জৈন, শিখদের ক্ষেত্রে বহুবিবাহ একটি আইনত অপরাধ। আলাদা আইন অনুসারে খ্রিস্টান ও পার্সি সম্প্রদায়ের ক্ষেত্রেও বহুবিবাহ নিষিদ্ধ।
কিন্তু ধারণাগত ও মনস্তাত্ত্বিক সমস্যার শুরু এখান থেকেই, কারণ মুসলমানদের ক্ষেত্রে মুসলিম পার্সোনাল ল (শরিয়ত) অ্যাপ্লিকেশন অ্যাক্ট ১৯৩৭ অনুযায়ী মুসলিম পুরুষের সর্বাধিক চারটি বিবাহের অনুমতি আছে। তবে এখানে কিছু শর্তও রয়েছে। এর ফলে এই ধারণার জন্ম হয়েছে যে “যেহেতু আইন অনুমতি দিয়েছে, মুসলমানরা বিপুলভাবে বহু বিবাহ করে।”
এন এফ এইচ এস (NFHS)- এর তথ্য অনুযায়ী
কিন্তু পরিসংখ্যান স্পষ্ট দেখিয়েছে যে আইনের অনুমতির অর্থ ব্যাপক প্রচলন নয়। বেশিরভাগ মুসলমানও জীবনে মাত্র একবার বিয়ে করেন, যেমনটি হিন্দু, শিখ বা খ্রিস্টানদের ক্ষেত্রেও দেখা যায়। আইনের কাঠামো ও বাস্তব সামাজিক চিত্রকে আলাদাভাবে বোঝা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ।
২০০৫-০৬ সালে NFHS-৩ এর সময় বহুবিবাহের হার বেশি ছিল, প্রায় ২ শতাংশ। ২০১৯-২১ সালে NFHS-৫ এর সময় এটি কমে ১.৪ শতাংশে নেমেছে। এবং আপনি হয়তো জেনে বিস্মিত হবেন যে ২০০৫ সালের সমীক্ষায় বৌদ্ধ ধর্মাবলম্বীদের মধ্যেই বহুবিবাহের সম্ভাবনা সবচেয়ে বেশি ছিল, ৩.৮ শতাংশ। একই সমীক্ষায় খ্রিস্টানদের মধ্যে বহুবিবাহের হার ছিল ২.৪ শতাংশ এবং মুসলমানদের মধ্যে ২.৬ শতাংশ।
সময়ের সঙ্গে সঙ্গে মুসিলম ও হিন্দুদের মধ্যে বহুবিবাহের ব্যবধানও কমে এসেছে। NFHS-৩ তে এই ব্যবধান বেশি ছিল, মুসলমানদের মধ্যে প্রায় ২.৬ শতাংশ এবং হিন্দুদের মধ্যে প্রায় ১.৮ শতাংশ। এখন NFHS-৫ তে এই ব্যবধান উল্লেখযোগ্যভাবে কমেছে, মুসলমানদের ক্ষেত্রে প্রায় ১.৯ শতাংশ এবং হিন্দুদের ক্ষেত্রে ১.৩ শতাংশ।
পরিসংখ্যানের আরও একটি আকর্ষণীয় দিক হল, ২০১৯ সালের সমীক্ষায় বৌদ্ধদের মধ্যে বহুবিবাহ কমে ১.৩ শতাংশে নেমে এসেছে, যদিও খ্রিস্টানদের ক্ষেত্রে এটি সামান্য কমে ২.১ শতাংশ হয়েছে। এমনকি ২০১৬ সালের NFHS-৪ পর সমীক্ষায় দেখা গেছে খ্রিস্টানদের মধ্যে বহুবিবাহ সামান্য বৃদ্ধি পেয়েছে। ২০১৬ সালে খ্রিস্টানদের মধ্যে বহুবিবাহের হার ছিল ২ শতাংশ, যা খুব সামান্য বেড়েছে।
বহু গবেষণামূলক বিশ্লেষণ স্পষ্ট দেখিয়েছে যে ভারতে সামগ্রিকভাবে বহুবিবাহ ধারাবাহিকভাবে হ্রাস পাচ্ছে, এবং এই হ্রাস শুধু মুসলমানদের নয়, সব ধর্মের মধ্যেই দেখা যাচ্ছে।
এখন বড় প্রশ্ন হলো, যখন তথ্য এত পরিষ্কারভাবে এই বাস্তবতা দেখাচ্ছে, তখন সমাজে “মুসলমানরা চারবার বিয়ে করে” এই ধারণা কীভাবে গড়ে উঠল?এর কয়েকটি কারণ রয়েছে, প্রথমত, আইনি বিতর্ক ও সংবাদমাধ্যমের আখ্যান। ইউনিফর্ম সিভিল কোড, মুসলিম পার্সোনাল ল, ট্রিপল তালাক ও বহুবিবাহ, এই সবকিছুকেই দীর্ঘদিন ধরে সংবাদমাধ্যম ও রাজনীতিতে ধারাবাহিকভাবে “মুসলমান বিষয়” হিসেবে উপস্থাপন করা হয়েছে। কোনো আইনের তাত্ত্বিক অনুমতিকে এমনভাবে প্রচার করা হয়েছে যেন প্রতিটি মুসলমান পুরুষ চারবার বিয়ে করে। যেন সকালে স্ত্রীর সঙ্গে তালাক হয়ে সন্ধ্যায় আবার বিবাহের শোভাযাত্রা চলছে।
এন এফ এইচ এস (NFHS)- এর তথ্য অনুযায়ী
দ্বিতীয় কারণ, ব্যক্তিগত উদাহরণকে সামগ্রিক সত্যে রূপান্তর। যদি কোনও পাড়া, আত্মীয় বা ভাইরাল ভিডিওতে দুই-তিনটি বহুবিবাহের ঘটনা দেখা যায়, তবে মানুষ ধরে নেয়, “পুরো সম্প্রদায়টাই এমন।” কিন্তু বৈজ্ঞানিক দৃষ্টিকোণ থেকে কিছু কেসকে পুরো সম্প্রদায়ের সত্য হিসেবে ধরা যায় না।
তৃতীয় কারণ, অপপ্রচার। “মুসলমানরা অনেক সন্তান জন্ম দিচ্ছে” ও “মুসলমানরা চারবার বিয়ে করছে”– এ ধরনের স্লোগান ধর্মীয় মেরুকরণের রাজনীতির জন্য অত্যন্ত লাভজনক। অথচ জন্মহার সংক্রান্ত সরকারি তথ্য স্পষ্টভাবে দেখাচ্ছে, মুসলমানদের জন্মহার দ্রুত হ্রাস পাচ্ছে এবং অন্যান্য সম্প্রদায়ের সঙ্গে ব্যবধান অনেক কমে এসেছে।
কিন্তু আমরা প্রায়ই একটি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ বিষয় ভুলে যাই, আমরা বহুবিবাহ নিয়ে আলোচনা করি ধর্ম বা রাজনীতির চোখে। অথচ যে পরিবারে এই ঘটনা ঘটে, সেই নারীর কাছে এটি ‘বিতর্ক’ নয়, বরং জীবন। হিন্দু, মুসলমান, খ্রিস্টান বা জনজাতীয় পরিবার, যেখানেই হোক না কেন, বহুবিবাহ নারীর অধিকার, আর্থিক নিরাপত্তা, মানসিক স্বাস্থ্য ও সামাজিক মর্যাদার ওপর গভীর প্রভাব ফেলে।
তাই বহুবিবাহের আলোচনা যদি কখনও গুরুত্বের সঙ্গে করা হয়, তবে তা কোনো ধর্মকে আক্রমণ করার অস্ত্র হিসেবে নয়, বরং লিঙ্গ ন্যায়ের দৃষ্টিভঙ্গি থেকেই করা উচিত। আজ দেশে ইউনিফর্ম সিভিল কোড ও বহুবিবাহ নিষিদ্ধকরণের মতো বিষয় নিয়ে তীব্র বিতর্ক চলছে। এমনকি একাধিক রাজ্য মুসলমানদের ক্ষেত্রে বহুবিবাহ নিষিদ্ধ করার পদক্ষেপও নিয়েছে। আইন কেমন হওয়া উচিত, তা আলাদা বিতর্ক। কিন্তু যদি আইনি বিতর্ক ভুয়া পরিসংখ্যান, বিভ্রান্তি এবং একটি সম্প্রদায়কে বদনাম করার উদ্দেশ্য থেকে পরিচালিত হয়, তাহলে সেই বিতর্ক কখনোই সৎ হতে পারে না।