“বিভেদের ঝড়ের মধ্যেও মানবতার হাতছানি, কাশ্মীরি হিন্দু-মুসলিম সৌহার্দ্যের এক অবিস্মরণীয় কাহিনি”

Story by  atv | Posted by  Aparna Das • 4 h ago
(AI দ্বারা প্রস্তুত করা ছবি )
(AI দ্বারা প্রস্তুত করা ছবি )
 
আশা খোসা 

১৯৯০-এর দশকের গোড়ার দিকে কাশ্মীরে সশস্ত্র সন্ত্রাস এবং সহিংসতা শুরু হলে কাশ্মীরি হিন্দুরা সত্যিই নিজেদের ঘরবাড়ি ছেড়ে পালিয়ে যেতে বাধ্য হয়েছিলেন। এটাও সত্য যে, যেসব বন্দুকধারীরা তাদের মধ্যে কিছু মানুষকে হত্যা করেছিল, তাদের বেশিরভাগই মুসলিম ছিল। কিন্তু এই অস্থির সময়কে শুধুমাত্র একটি সাধারণীকরণ দিয়ে ব্যাখ্যা করা যায় না; বাস্তবতা অনেক বেশি সূক্ষ্ম বিষয়টি সবসময় সাদা-কালো নয়, মাঝখানে অসংখ্য ধূসর স্তর রয়েছে।
 
Unforgettable experiences 
 
এটি আমার মামার গল্প, আমার মায়ের চার ভাই-বোনের মধ্যে সবচেয়ে ছোট। তিনি কাশ্মীরের কেন্দ্রীয় অঞ্চলের বদগাম জেলার চরার-এ-শরিফের মাজারের কাছের এক গ্রামে থাকতেন। তাঁর সঙ্গে বাস করতেন মা, স্ত্রী ও তিন সন্তান, দুই মেয়ে ও এক ছেলে। কোনও ব্যক্তিগত কারণে তিনি স্কুলের বাইরে আর পড়াশোনা করেননি।
 
মামার ছিল একটি ধানক্ষেত, একটি ফলের বাগান, একটি সবজি বাগান, ছোট চাল ও তেলের কল। গ্রামে তিনি সুখী ও নিশ্চিন্ত জীবন যাপন করতেন। তাঁর বাড়ির সামনে দিয়ে একটি ছোট খাল বয়ে যেত। বাড়ির দ্বিতীয় তলার ফরাসি জানালা থেকে বসে আমরা প্রায়ই দেখতাম, মামা মিল বন্ধ করছেন, খালের উপারের সেই কলগুলো তালা দিয়ে বাড়ির দিকে হাঁটছেন দুপুরে খাবার ও একটু বিশ্রামের জন্য।
 

যখন কাশ্মীরে অশান্তি চরমে পৌঁছল এবং ১৯৯০-এর জানুয়ারি-ফেব্রুয়ারিতে হিন্দুরা গণহারে পালাতে শুরু করলেন, মামা কোনওভাবেই যেতে চাইছিলেন না। আমাদের বড় যৌথ পরিবার সবাই প্রচণ্ড উদ্বেগে ছিল। কিন্তু তিনি একটুও অনড় ছিলেন।
 
“আমরা গ্রামবাসীরা, হিন্দু আর মুসলিম, একসঙ্গে থাকার এবং একে-অপরকে সাহায্য করার শপথ নিয়েছি। এই প্রতিশ্রুতি আমি ভাঙতে পারি না, আর ভাঙার কোনও কারণও নেই,” তিনি তাঁর বোন ও বড় ভাইকে বলতেন, যারা তখন জম্মুতে ফোন করে তাকে সরে যেতে অনুরোধ করতেন, যেখানে অধিকাংশ কাশ্মীরি পরিবার আশ্রয় নিয়েছিল।
 
কাশ্মীরে পরিস্থিতি কতটা টানটান ছিল, তা ভাষায় প্রকাশ করা কঠিন। এর আগে কখনও কাশ্মীর এমন মাত্রার সহিংসতা, লক্ষ্যভিত্তিক হত্যা ও সামাজিক অস্থিরতা দেখেনি। তবু ওই নির্দিষ্ট গ্রামটির মানুষ যেন জোয়ার থেকে বিপরীতমুখে হাঁটার সিদ্ধান্ত নিয়েছিল।
 
যখন অন্য গ্রামগুলিতে হিন্দুরা প্রাণভয়ে বাড়িঘর ছাড়ছিলেন, সেই গ্রামে মুসলমানেরা উল্টে হিন্দুদের থাকতে অনুরোধ করছিলেন এবং সুরক্ষার প্রতিশ্রুতি দিচ্ছিলেন। মুসলমানদের কাছে হিন্দুদের উপস্থিতি ছিল একধরনের নিশ্চয়তা, এতে জঙ্গিরা স্বচ্ছন্দে ঘোরাঘুরি করতে পারবে না এবং সেনাবাহিনী ও নিরাপত্তা বাহিনীর অভিযানও তুলনামূলকভাবে নরম থাকবে।
 
(AI দ্বারা প্রস্তুত করা ছবি )
 
পরবর্তীতে সাংবাদিকতা শুরু করার পর বুঝেছি, মামার মতো কিছু মানুষ, যারা শিক্ষিত ছিলেন না বা নিজেদের গ্রামের বাইরে জীবনের চ্যালেঞ্জ মোকাবিলা করতে অভ্যস্ত ছিলেন না, তারা স্থানান্তর হওয়ার ধারণাকেই ভয় পেতেন।
 
এক গরম দুপুরে মামা তাঁর মিল বন্ধ করছিলেন খাবারের জন্য বাড়ি যাওয়ার আগে। ঠিক সেই সময় এক অচেনা ব্যক্তি তাঁর কাছে এসে বলল, “আপনি কি বাবলুজির বাড়ির রাস্তা দেখিয়ে দিতে পারেন?” বাবলুজি ছিলেন দক্ষিণ কাশ্মীরের পুলওয়ামায় কর্মরত এক ইঞ্জিনিয়ার। তাঁর বৃদ্ধা মা একা থাকতেন, তাদের বাড়ি ছিল আমাদের বাড়ির পিছনের দিকে।
 
অন্যান্য অ-মুসলিমদের মতো বাবলুজিও সরকারি নীতিমালা অনুযায়ী নিরাপদ এলাকায় কাজ করতেন ও থাকতেন। মাঝেমধ্যে তিনি মাকে দেখে যেতে বাড়ি ফিরতেন। মামা লোকটিকে বাবলুজির বাড়ির ঠিকানা বলে দিলেন।
 
মিলের দুটি ফটক বন্ধ করে মামা খালের উপর ছোট সেতু পার হয়ে বাড়ির দিকে হাঁটছিলেন। ঠিক তখনই তিনি গুলির শব্দ শুনলেন। আখরোট ও পপলার গাছে বসে থাকা পাখিরা ভয়ে উড়ে গেল। এক মহিলার বুকভাঙা আর্তনাদ গ্রামের নির্জনতাকে ছিন্নভিন্ন করে দিল। মুহূর্তের মধ্যে গ্রামবাসীরা দৌড়ে বাবলুজির বাড়ির দিকে ছুটলেন। ঘটনায় শোকেভরা, হতবাক মামা সেখানেই যেন পাথর হয়ে যান। পরে গ্রামবাসীরা তাঁকে আধা-অচেতন অবস্থায় বাড়ি নিয়ে আসেন।
 
(AI দ্বারা প্রস্তুত করা ছবি )
 
বাবলুজি বাড়িতে ঢোকার কিছু পরেই দরজায় কড়া নাড়া পড়ে। তাঁর মা দরজা খোলেন। লোকটি বলে, “বাবলুজি কি বাড়িতে আছে? তার সঙ্গে দেখা করতে হবে।” বাবলুজি উপরতলা থেকে নিচে আসতেই লোকটি পিস্তল বের করে তাকে গুলি করে। মায়ের চোখের সামনে বাবলুজির মৃত্যু হয়।
 
এই হত্যাকাণ্ড পুরো গ্রামের ঐক্যের বিশ্বাসকে ভেঙে চুরমার করে দিল। মানুষ উপলব্ধি করল, নতুন কাশ্মীরে বন্দুকধারী অপরিচিতরা ইচ্ছা করলেই যে কাউকে খুন করতে পারে। কারও নিরাপত্তা আর কারও হাতে নেই।
 
মামা নিজেকে অপরাধী মনে করতে লাগলেন, কারণ তিনিই তো খুনিকে বাবলুজির বাড়ি দেখিয়ে দিয়েছিলেন। দিনের আলোয় প্রকাশ্যে খুন, তা গোটা গ্রামকে স্তব্ধ করে দিল। মন ভেঙে মুসলমান প্রতিবেশীরা তখন হিন্দুদের বললেন, “আমরা তোমাদের আর রক্ষা করতে পারব না। তোমাদের চলে যাওয়াই এখন নিরাপদ।”
 
হিন্দুরা তাড়াতাড়ি মূল্যবান জিনিসপত্র গুছিয়ে নিলেন। সন্ধ্যা হতে গ্রামবাসীরা কয়েকটি ট্রাকের ব্যবস্থা করলেন তাদের যাবার জন্য, ৩০০ কিলোমিটার দূরের জম্মুতে। বিদায়ের সময় মুসলিম প্রতিবেশীরা চোখের জলে বিদায় জানালেন এবং অনুরোধ করলেন, “পরিস্থিতি ভালো হলে ফিরে আসবে।”
 
হিন্দু প্রতিবেশীদের অশ্রুসিক্ত বিদায় জানাচ্ছেন মুসলিমরা (AI দ্বারা প্রস্তুত করা ছবি )
 
রাতের গভীরে ট্রাক NH-44 ধরে জম্মুর দিকে এগোল। ট্রাকে কেউ একটি শব্দও বলল না। মামা, তাঁর স্ত্রী ও সন্তানদের মনে ভবিষ্যৎ নিয়ে চিন্তা আর ভয়। পরের দিন ট্রাক জম্মুতে পৌঁছাল, প্রখর রোদ, অসহ্য গরম। মামার পরিবার বুঝতে পারছিল না কোথায় যাবে। মামা চালকের হাতে ভাড়ার টাকা দিতে চাইলে অবিশ্বাস্য ঘটনা ঘটল।
 
ড্রাইভার চোখ ভিজিয়ে টাকা নিতে অস্বীকার করলেন। উল্টে নিজের পকেট থেকে কয়েকটি টাকা মামার হাতে গুঁজে দিয়ে তাঁর মুঠো চেপে ধরলেন। “আমি তোমার কাছ থেকে টাকা নিতে পারব না। আমি তোমাকে সাহায্য করিনি, আমি তোমাকে তোমার শিকড় থেকে উপড়ে ফেলে, অজানা পথে নামিয়ে দিয়েছি।” তখন দু’জনের বুকফাটা কান্না ঝরে পড়ল, মানবতার চোখের জল।
 
(পাঠকদের প্রতি আহ্বান: যারা সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি বা আন্তধর্মীয় বন্ধুত্বের অভিজ্ঞতা ভাগ করে নিতে চান, তারা নিজেদের অভিজ্ঞতা পাঠাতে পারেন: [email protected], সম্পাদক)