আর্সলা খান
আজমের শরিফ দরগাহ কেবল বিশ্বাসের কেন্দ্র নয়, বরং এমন এক আধ্যাত্মিক ভূমি যেখানে মানবতা, সমতা এবং ভ্রাতৃত্ব প্রতিমুহূর্তে প্রবাহিত। শতাব্দীর পর শতাব্দী ধরে খাজা মইনুদ্দিন চিশতীর এই মাজার আধ্যাত্মিক শক্তির উৎস এবং সামাজিক সম্প্রীতির আসন। এই পবিত্র স্থানে থাকা বড় ও ছোট হাঁড়িগুলি কেবল লোহা বা তামার পাত্র নয়, এগুলি এমন এক ঐতিহ্যের প্রতীক যা হিন্দু-মুসলিম ঐক্যের বার্তা বহন করে এবং প্রতিটি দর্শনার্থী শ্রদ্ধার দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকে।
ডেগের ঐতিহ্য
আজমের দরগায় রয়েছে দুটি বড় এবং দুটি ছোট ডেগ, যেগুলি এত বড় যে একসঙ্গে শত শত মানুষের জন্য খাবার রান্না করা যায়। এই ডেগে প্রস্তুত হওয়া খিচুড়ি এবং পোলাও কেবল খাদ্য নয়, এটি সমতা, অন্তর্ভুক্তি এবং মানবতার যৌথ উত্তরাধিকারবাহী একটি বার্তা, যা সময় ও ইতিহাসের সঙ্গে পরিপুষ্ট। প্রতিটি নিবেদন, প্রতিটি প্রার্থনা এবং প্রতিটি মানতের খাদ্য প্রস্তুতি ‘খাজা সাহেবের দরগায় প্রবেশ করা প্রত্যেকেই সমান’, এই সত্যকে স্মরণ করিয়ে দেয়, ধর্ম-জাতি-ভাষা-দেশ নির্বিশেষে।
আজমের শরীফ দরগায় ডেগে রান্না করার একটি দৃশ্য
আজমেরের ডেগে রান্নার আচার কোনও একক ধর্মের মধ্যে সীমাবদ্ধ নয়। আশ্চর্যজনকভাবে, হিন্দু, মুসলিম, শিখ ও দলিত, সব সম্প্রদায়ের মানুষই ডেগে রান্না হওয়া খাদ্য তৈরির কাজে অংশগ্রহণ করেন। পবিত্র খাদ্য তৈরির উদ্দেশ্যে যে উপাদান বা অর্থ দেওয়া হয়, তা সকলেই নিবেদন করেন; এবং দরগাহের পবিত্র প্রাঙ্গণে রান্না হওয়া সেই খাদ্য সবার মাঝে ভাগ করে দেওয়া হয়। দরগার অভ্যন্তরে একটিই বাক্য প্রায়ই প্রতিধ্বনিত হয়, “ডেগ খাজা কি, সেবা সবকি” (ডেগ খাজার, সেবা সবার জন্য)।
এই কারণেই, যখন কোনও হিন্দু ভক্ত ডেগে নিবেদন প্রদান করেন, মুসলিম খাদেমরা তা একই শ্রদ্ধা ও সম্মানের সঙ্গে গ্রহণ করেন, যেমন তারা সজ্জিত মুসলিম ভক্তের নিবেদন গ্রহণ করেন। ডেগের সামনে এই মিলনের রীতি নীরবে এক গভীর বার্তা দেয়, ধর্ম কোনও প্রাচীর নয়, ধর্ম একটি সেতু।
আজমের শরীফ দরগায় সকল ধর্মের মানুষ ডেগে রান্না করা খাবার খাওয়ার একটি দৃশ্য
ডেগ-রান্না করা খাবার
ডেগ নিবেদনের পর যখন দরগাহের আঙিনায় উপস্থিত সবার মাঝে সেই খাদ্য বিতরণ করা হয়, তখন এখানে ধর্মভেদে কোনও সারি থাকে না, কারও প্লেটে কোনও ভিন্নতা থাকে না। একই ডেগের খাবার হিন্দু, মুসলিম, শিখ ও খ্রিস্টান, সকলকে পরিবেশন করা হয়। একাধিকবার দেখা গেছে, একটি পরিবার হিন্দু, আরেকটি মুসলিম, কিন্তু ডেগের খাবার খাওয়ার পর উভয় পরিবারই পরস্পরের সন্তানকে প্রথম গ্রাস খাইয়ে দেয়। এই দৃশ্য ধর্মীয় সীমানাকে মুছে দেয়।
আকবরের দরগাহ-সংযোগ
ডেগের ইতিহাসও হিন্দু-মুসলিম ঐক্যের গল্প বলে। কথিত আছে, সম্রাট আকবর যখনই কোনও অভিযানে বের হতেন, তার আগে আজমের শরিফে এসে ডেগ নিবেদন করতেন। সর্ববৃহৎ ডেগটি তার উদ্যোগেই স্থাপিত। আকবর নিজে খালি পায়ে দরগায় আসতেন, সঙ্গে আনতেন হিন্দু ও মুসলিম সম্প্রদায়ের সদস্যদের, ডেগ নিবেদন করতেন এবং খাবার সবার মাঝে বিতরণ করতেন। শতাব্দী অতীত হলেও এই প্রথা আজও অটুট। আকবরের ডেগে রান্না হওয়া খিচুড়ি আজও ভক্তি, ভ্রাতৃত্ব এবং সেই ঐতিহাসিক সময়ের সুবাস বহন করে।
ডেগকে ঘিরে নৈবেদ্য প্রদান অনুষ্ঠান
গঙ্গা-যমুনা সংস্কৃতি
আজমেরের ডেগে রান্না হওয়া খাবারের সুগন্ধ কেবল খাবারের সুগন্ধ নয়, এটি ভারতের গঙ্গা-যমুনা সংস্কৃতির সুবাস। ডেগ নিবেদনের আচার চলাকালে বহু হিন্দু নারী নিজের হাতে হলুদ ও চাল নিবেদন করেন, এবং মুসলিম খাদেমরা দোয়া পড়েন। এই দৃশ্য মানবতার বিরল সমন্বয়কে ফুটিয়ে তোলে।
খাদ্য ও চিন্তার খোরাক
দরগাহে ডেগের খাবার চান, ধনী, দরিদ্র, হিন্দু, মুসলিম, শিখ, দলিত, সকলেই। খাবারের স্বাদ সবার কাছে একই থাকে, কিন্তু এর বার্তা প্রত্যেকের কাছে আলাদা করে পৌঁছায়। কারও কাছে এটি মানত পূরণের আনন্দ, কারও কাছে জীবনে নতুন সূচনার আশা, আবার কারও কাছে উপলব্ধি, মানবতা ধর্মের ঊর্ধ্বে।
দরগাহের আঙিনায় মানুষ যখন ডেগের চারপাশে দাঁড়িয়ে দোয়া করেন, তখন অনুভব হয়, খাজার দরগায় মানবতাই সর্বশ্রেষ্ঠ ধর্ম। ডেগের খাবার শুধু পেট ভরায় না, এটি হৃদয় ভরায় ভালোবাসা, শ্রদ্ধা ও ঐক্যের অনুভূতিতে।