শম্পি চক্রবর্তী পুরকায়স্থ
যখন চারদিকে হিন্দু-মুসলিম বিভেদের খবর, সম্প্রদায়িক সংঘাত আর ঘৃণার আগুনের ছোঁয়া ছড়িয়ে পড়ে দেশের নানা প্রান্তে, তখনও কিছু গল্প নীরবে মানবতার সুর বয়ে আনে। পশ্চিমবঙ্গের উত্তর ২৪ পরগনার বারাসতের বোস পরিবার সেই মানবতার এক উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত। বিগত প্রায় ছয় দশক ধরে এই হিন্দু পরিবারটি যত্নে-ভালোবাসায় দেখভাল করছে এক প্রাচীন মুসলিম মসজিদ, আমানতি মসজিদ।
১৯৬৪ সাল। দেশভাগের পরবর্তী অস্থির সময়ে পূর্ব পাকিস্তানের খুলনায় বসবাস করতেন ঈশ্বর নিরোধ বোস। সেখানকার দাঙ্গা ও অশান্তির কারণে পরিবারসহ ভারতে চলে আসেন তিনি। সরকারি নিয়ম অনুযায়ী জমি বিনিময় প্রক্রিয়ায় তিনি খুলনার জমির পরিবর্তে পান উত্তর ২৪ পরগনার বারাসতে অবস্থিত একখণ্ড জমি। জমির পূর্ব মালিক ছিলেন গিয়াসউদ্দিন মোরল। কিন্তু সেই জমিতে একটি ছোট মসজিদও ছিল, যেটি মোরল সাহেব ছেড়ে যান নবাগত বোস পরিবারের তত্ত্বাবধানে।
মসজিদে প্রার্থনার সময়
সেই সময়ের সমাজব্যবস্থার প্রেক্ষিতে অনেকেই হয়তো এমন মসজিদ ভেঙে নিজেদের মতো করে ব্যবহার করতেন। কিন্তু ঈশ্বর নিরোধ বোসের মানসিকতা ছিল একেবারেই আলাদা। তিনি মসজিদটি রক্ষা করার সিদ্ধান্ত নেন। তাঁর স্ত্রী প্রথম দিনই মসজিদের চত্বরে প্রদীপ জ্বালিয়ে প্রার্থনা করেছিলেন, যেন এই পবিত্র স্থান সবার উপাসনার আশ্রয় হয়ে থাকে। সেই থেকেই শুরু হয় এক হিন্দু পরিবারের হাতে এক মুসলিম উপাসনালয়ের দেখভাল।
এখন বোস পরিবারের দ্বিতীয় প্রজন্মের কর্ণধার ৭৪ বছরের দীপক বোস। তিনি বলেন,“আমি তখন ১৪ বছরের। খুলনা থেকে আমরা যখন এলাম, দেখি জমির ওপর ছোট্ট একটা মসজিদ। বাবা বলেছিলেন, এটা ঈশ্বরের ঘর, তাই সম্মান করতে হবে। সেই থেকেই আমরা যত্নে রেখেছি।”
মসজিদের দেখাশোনার দায়িত্বে থাকা বোস পরিবারের সদস্য পার্থসারথি বোস
দীপকবাবুর কথায়, তাঁদের পরিবার কখনও ভাবেননি যে ধর্মের ভিন্নতা কোনো বিভেদ তৈরি করতে পারে। বরং এই মসজিদ তাঁদের জীবনেরই এক অংশ হয়ে উঠেছে। আজও প্রতিদিন এখানে নামাজ পড়েন আশপাশের মুসলমান প্রতিবেশীরা। বোস পরিবার নিজের খরচে মসজিদের মেরামত, রঙ করা, এমনকি ইমামের বেতন পর্যন্ত দেন।
বর্তমানে পরিবারের তৃতীয় প্রজন্ম, পার্থ সারথি বোস, সেই দায়িত্ব সামলাচ্ছেন। তিনি গর্বের সুরে বলেন, “আমার দাদু, বাবা, সবাই মসজিদটিকে নিজেদের পরিবারের অংশ মনে করেছেন। আমরাও তাই করি। আমার মেয়ে বলেছে, ভবিষ্যতে সেও এই দায়িত্ব নেবে।"
আমানতী মসজিদের ইমাম আখতার আলি
রমজানের মাসে মসজিদ চত্বরে প্রতিদিন ইফতারের আয়োজন হয়। আশপাশের মুসলিম পরিবারগুলির সঙ্গে বোস পরিবারও বসেন একই পাতে। এই মিলনের ছবি যেন ধর্মের সীমা ছাড়িয়ে মানুষকে এক সুতোয় বেঁধে দেয়। পার্থ সারথি বোস বলেন,“আমরা সকলে ঈশ্বরকে বিভিন্ন নামে ডাকি, কিন্তু তিনি এক। তাই এই জায়গা শুধু মুসলমানদের নয়, আমাদেরও।”
আমানতি মসজিদের ইমাম আখতার আলি জানান, “এই মসজিদটি প্রাক-স্বাধীনতা সময়ের। আগে অবহেলিত অবস্থায় ছিল, কিন্তু বোস পরিবার দায়িত্ব নেওয়ার পরই এর সৌন্দর্য ও ঐতিহ্য ফিরে এসেছে। এমন যত্নে মসজিদ কেউ দেখেনি।”
মসজিদের সামনে অবসর সময়ে স্থানীয়রা
ইমামের কথায়, বোস পরিবারের এই মানবিকতা আজও এলাকার মুসলমানদের কাছে এক আশীর্বাদের মতো।
পার্থ সারথি বোস আরও বলেন, “আমরা কখনও কোনো রাজনৈতিক বা ধর্মীয় চাপে পড়িনি। বাবা যেমন শুরু করেছিলেন, আমরাও সেই পথে আছি। ধর্ম আলাদা হতে পারে, কিন্তু ঈশ্বর এক।” এই কথাই যেন বোস পরিবারের মূল মন্ত্র।
বারাসতের আমানতি মসজিদ আজ শুধু একটি উপাসনালয় নয়, বরং এক প্রতীক, যা বোঝায়, ধর্ম নয়, মানবতাই শ্রেষ্ঠ। পঞ্চাশ বছরেরও বেশি সময় ধরে এক হিন্দু পরিবারের হাতে মুসলিম মসজিদের এমন যত্ন ও ভালোবাসা সত্যিই বিরল। এক পৃথিবী যেখানে বিভেদ বাড়ছে, সেখানে বোস পরিবারের এই গল্প মনে করিয়ে দেয় রবীন্দ্রনাথের সেই কথা, “যে ধর্মে মানুষে মানুষে ভেদ ঘটে, সে ধর্ম নয়।” বারাসতের এই ছোট্ট মসজিদ তাই আজও দাঁড়িয়ে আছে সম্প্রীতির মশাল হাতে, প্রমাণ হিসেবে যে, মানবতার কাছে সব ধর্মই সমান।