ইসলামে সদয়তা শুধু একটি নৈতিক গুণ নয়; এটি ঈমানের প্রতিফলন। আল্লাহ তাআলা নিজেকে বর্ণনা করেছেন “আরহামুর রাহিমীন”, অর্থাৎ “দয়ালুদের মধ্যে সর্বাধিক দয়ালু”, এবং প্রেরণ করেছেন নবী মুহাম্মদকে (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) “রহমাতান লিল-আলামীন”, অর্থাৎ “সমস্ত জগতের প্রতি রহমত” হিসেবে। সুতরাং, দয়া ও করুণা ইসলামের পার্শ্ব শিক্ষা নয়; বরং তার মূল সত্তা।
প্রতীকী ছবি
মানবতার টিকে থাকা, ভালোবাসার প্রসার এবং শান্তির প্রতিষ্ঠা, সবই করুণা ও সহমর্মিতার ওপর নির্ভর করে। সদয়তাই আমাদের সত্যিকার অর্থে মানুষ করে তোলে, এটি হৃদয়কে যুক্ত করে, ঘৃণা মুছে দেয় এবং বিশ্বাস গড়ে তোলে। এই মহৎ চেতনা প্রচারের লক্ষ্যে প্রতি বছর ১৩ নভেম্বর বিশ্বজুড়ে পালিত হয় বিশ্ব সদয়তা দিবস। এর উদ্দেশ্য হলো মানুষের মধ্যে শুভেচ্ছা, সহানুভূতি ও ঐক্য জাগানো। কিন্তু ইসলাম চৌদ্দ শতাব্দীরও আগে এই বার্তা প্রদান করেছিল, যা যে কোনো আন্তর্জাতিক উদযাপনের চেয়েও অনেক বিস্তৃত ও গভীর।
ইসলামে সদয়তা হলো ঈমানের প্রকাশ এবং জীবনযাপনের এক অবিচ্ছেদ্য অংশ। কুরআন ও নবীজির (সা.) শিক্ষা বারবার বিশ্বাসীদের দয়া ও কোমলতার পথে আহ্বান জানায়। আল্লাহ বলেন, “নিশ্চয়ই আল্লাহ সুবিচার ও সদয়তার নির্দেশ দেন।”(সূরা আন-নাহল ১৬:৯০)
আরবি শব্দ ইহসান (সদয়তা) অর্থ হলো, কল্যাণ করা, এমনকি তাদের প্রতিও যারা হয়তো এর যোগ্য নয়। নবীজির (সা.) জীবন এই নীতির নিখুঁত প্রতিফলন। তিনি বলেছেন, “তোমাদের মধ্যে শ্রেষ্ঠ সেই ব্যক্তি, যে অন্যদের জন্য সবচেয়ে বেশি উপকারী।” (মুসনাদ আহমাদ) এবং “যে দয়া প্রদর্শন করে না, তার প্রতি দয়া করা হবে না।” (সহিহ বুখারি)
নবী করিম (সা.) শুধু দুর্বল ও দরিদ্রদের প্রতিই নয়, পশু-পাখি ও এমনকি তাঁর শত্রুদের প্রতিও করুণা প্রদর্শন করেছেন। তাঁর জীবন ছিল সর্বজনীন সদয়তার জীবন্ত দৃষ্টান্ত, যা বর্ণ, ধর্ম বা প্রজাতির সীমা অতিক্রম করেছে।কুরআন বিশ্বাসীদের উৎসাহিত করেছে আল্লাহর পথে ব্যয় করতে এবং নিঃস্বার্থভাবে অন্যদের সাহায্য করতে, “যারা আল্লাহর পথে তাদের ধন-সম্পদ ব্যয় করে, তাদের দৃষ্টান্ত সেই বীজের মতো, যা থেকে সাতটি শীষ জন্মে, আর প্রতিটি শীষে থাকে একশত দানা।” (সূরা আল-বাকারা ২:২৬১)
ইসলামে দান একটি ইবাদত, যা সম্পদকে পবিত্র করে এবং বিনয় সৃষ্টি করে। নবীজী (সা.) বলেছেন, “তোমার ভাইয়ের প্রতি তোমার হাসিটিও দান।” (তিরমিজি) অতএব, সদয়তা কেবল অর্থ দেওয়াতে সীমাবদ্ধ নয়, এটি প্রতিটি সৎকাজে বিদ্যমান, যেমন একটি হাসি, সান্ত্বনামূলক বাক্য, বা বিপদে কারো পাশে দাঁড়ানো। দান হৃদয়কে কোমল করে এবং মানবতার বোধকে শক্তিশালী করে। ইসলাম প্রতিবেশীর প্রতি সম্মান ও যত্ন নেওয়ার ওপর বিশেষ গুরুত্ব দিয়েছে। নবীজী (সা.) বলেছেন, “যে তার প্রতিবেশীর প্রতি সদয় নয়, সে প্রকৃত মুমিন নয়।” (সহিহ বুখারি)
প্রতীকী ছবি
তিনি আরও বলেছেন, ফেরেশতা জিবরাইল (আ.) এতবার প্রতিবেশীর অধিকার সম্পর্কে তাঁকে স্মরণ করিয়ে দিয়েছিলেন যে, তিনি ভেবেছিলেন প্রতিবেশীরা হয়তো উত্তরাধিকারেও অংশ পাবেন। ইসলাম শেখায়, প্রতিবেশীর ধর্ম বা জাতি নয়, মানবতাই আসল। প্রতিবেশীর দুঃখে পাশে থাকা, অসুস্থ হলে দেখতে যাওয়া, আনন্দে শরিক হওয়া, সবই ঈমানের অংশ।
ইসলাম জীবজগতের সকল প্রাণীর প্রতিও করুণা প্রসারিত করেছে। নবীজী (সা.) বলেছেন, “এক নারীকে শাস্তি দেওয়া হয়েছিল কারণ সে একটি বিড়ালকে বন্দী করে রেখেছিল, আর একজন মানুষকে ক্ষমা করা হয়েছিল কারণ সে এক তৃষ্ণার্ত কুকুরকে পানি দিয়েছিল।” (সহিহ বুখারি)
এই ঘটনাটি প্রমাণ করে যে আল্লাহর কাছে প্রতিটি দয়ার কাজ, এমনকি কোনো প্রাণীর প্রতিও, অমূল্য। নবীজী (সা.) প্রাণীদের প্রতি নিষ্ঠুরতা নিষিদ্ধ করেছেন; তিনি নির্দেশ দিয়েছেন যেন তাদের অতিরিক্ত বোঝা না দেওয়া হয় বা খেলাচ্ছলে আঘাত না করা হয়। তিনি বলেছেন, “যে আল্লাহর সৃষ্টির প্রতি দয়া দেখায় না, আল্লাহও তার প্রতি দয়া করবেন না।” (বুখারি)
ইসলামের দয়া তাই সর্বজনীন, তা সকল জীবের প্রতিই প্রসারিত। ইসলাম প্রথম ধর্ম যা শ্রমিক ও কর্মচারীর অধিকারকে পবিত্র ঘোষণা করেছে। নবীজী (সা.) বলেছেন, “তোমার দাসদের সেই খাদ্য খাওয়াও যা তুমি খাও, এবং সেই পোশাক পরাও যা তুমি পর।” (সহিহ বুখারি) আরও বলেছেন, “তারা তোমাদের ভাই; আল্লাহ তাদের তোমাদের তত্ত্বাবধানে রেখেছেন।” (সহিহ মুসলিম)
এই শিক্ষাগুলো আজও প্রাসঙ্গিক। আধুনিক বিশ্বে এগুলো সকল শ্রমিক ও কর্মীর ক্ষেত্রে প্রযোজ্য, আমাদের স্মরণ করিয়ে দেয় যে, সম্মান, ন্যায় ও মানবিকতা বজায় রাখতে হবে। ইসলাম এমন একটি সমাজব্যবস্থা প্রতিষ্ঠা করতে চায় যা ন্যায় ও করুণার ওপর দাঁড়িয়ে আছে এবং প্রতিটি মানুষের মর্যাদা নিশ্চিত করে।
প্রতীকী ছবি
মানব ইতিহাসে সদয়তার সবচেয়ে বিস্ময়কর উদাহরণগুলোর একটি হলো মক্কার বিজয়। দীর্ঘ নির্যাতন ও কষ্টের পর নবীজী (সা.) বিজয়ী হিসেবে মক্কায় প্রবেশ করেন। কিন্তু প্রতিশোধ না নিয়ে তিনি ঘোষণা করেন, “আজ তোমাদের ওপর কোনো দোষ নেই; যাও, তোমরা মুক্ত।”
এই দয়ার আচরণ হৃদয় বদলে দিয়েছিল, শত্রুরাও বন্ধুতে পরিণত হয়েছিল। কুরআন বলে, “সৎকর্ম ও অসৎকর্ম সমান নয়। তুমি অসৎকর্মকে উত্তম কর্ম দিয়ে প্রতিহত কর; তাহলে দেখবে, যাকে তুমি শত্রু মনে করতে, সে তোমার অন্তরঙ্গ বন্ধু হয়ে গেছে।”
(সূরা ফুসসিলাত ৪১:৩৪)
এটাই ইসলামী সদয়তার মূল শিক্ষা, ঘৃণার জবাবে মমতা, সংঘাতের পরিবর্তে সহানুভূতি। ইসলামে সদয়তা কোনো ঐচ্ছিক বিষয় নয়; এটি ঈমানের সারাংশ। দান করা, প্রতিবেশীর যত্ন নেওয়া, প্রাণীর প্রতি দয়া, শ্রমিকের সঙ্গে ন্যায় আচরণ করা বা শত্রুকে ক্ষমা করা, প্রতিটি করুণাময় কাজই ইবাদতের অংশ।
আজকের পৃথিবীতে, যেখানে রাগ, বিভাজন ও স্বার্থপরতা বেড়ে চলেছে, সেখানে সদয়তার প্রয়োজন আগের যেকোনো সময়ের চেয়ে বেশি। এটি হৃদয় সারিয়ে তোলে, সমাজকে পুনর্গঠিত করে। বিশ্ব সদয়তা দিবস আমাদের স্মরণ করিয়ে দেয়, আমাদের অন্তরে সেই প্রাকৃতিক দয়ার চেতনা পুনর্জীবিত করতে হবে। কিন্তু ইসলাম ইতিমধ্যেই বিশ্বকে শিখিয়েছে, কোমলতাই ঈমান, দয়াই ইবাদত, আর ভালোবাসাই উপাসনার আত্মা।
(ড. জাফর দারিক কাসমি, ইসলামি পণ্ডিত ও লেখক, আলীগড়।)