দেবকিশোর চক্রবর্তী, বর্ধমান
রেলস্টেশনে হঠাৎই তৈরি হল তীব্র আতঙ্কের পরিবেশ। গতকাল বিকেল সাড়ে পাঁচটার সময় বর্ধমান রেলস্টেশনের প্ল্যাটফর্ম নম্বর ৪ ও ৫-এর মাঝের ফুটওভারব্রিজে ঘটে ভয়াবহ দুর্ঘটনা। একজন মহিলা ভারসাম্য হারিয়ে নিচে পড়ে গেলে মুহূর্তের মধ্যে চাপে পড়ে যান আশপাশের যাত্রীরা। তৈরি হয় পদপিষ্ঠের মতো পরিস্থিতি। চিৎকার-চেঁচামেচিতে মুহূর্তেই ছড়িয়ে পড়ে আতঙ্ক।
প্রত্যক্ষদর্শীদের মতে, বিকেলবেলা স্টেশনে ভয়াবহ ভিড় ছিল। একাধিক ট্রেন একসঙ্গে বিভিন্ন প্ল্যাটফর্মে ঢোকার ফলে যাত্রীরা একযোগে ফুটওভারব্রিজে ওঠানামা করছিলেন। সেই সময়ই দুর্ঘটনাটি ঘটে। অনেকে অভিযোগ করেছেন, স্টেশনের এস্কেলেটারটি বন্ধ থাকায় সবাইকে সিঁড়ি ব্যবহার করতে হচ্ছিল। ফলে ভিড়ের চাপে ভারসাম্য হারিয়ে পড়ে যান ওই মহিলা যাত্রী, যার ফলে অন্যান্যরাও হুড়োহুড়িতে নিচে পড়ে যান।
দুর্ঘটনায় এখন পর্যন্ত আট জনের আহত হওয়ার খবর পাওয়া গিয়েছে, যার মধ্যে পাঁচজন মহিলা ও তিনজন পুরুষ। যদিও কিছু সূত্রের দাবি, আহতের সংখ্যা ১২ পর্যন্ত হতে পারে। আহতদের মধ্যে তিনজনের অবস্থা আশঙ্কাজনক বলে জানা গেছে। তাঁদের দ্রুত বর্ধমান মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালে ভর্তি করা হয়। হাসপাতাল সূত্রে জানা গেছে, একাধিক আহতের মাথা ও পায়ে গুরুতর আঘাত লেগেছে।
ঘটনার পরপরই রেলওয়ে প্রোটেকশন ফোর্স (RPF) এবং রেলকর্মীরা ছুটে আসেন দুর্ঘটনাস্থলে। স্থানীয় চিকিৎসকরাও দ্রুত সেখানে উপস্থিত হয়ে আহতদের প্রাথমিক চিকিৎসা দেন। স্টেশনের ভেতরে কিছু সময়ের জন্য ট্রেন চলাচল বন্ধ রাখা হয়, যাতে ভিড় নিয়ন্ত্রণ করা যায় ও আহতদের নিরাপদে সরানো সম্ভব হয়।
রেল কর্তৃপক্ষের তরফে জানানো হয়েছে, এটি কোনও "স্ট্যাম্পিড" বা পদপিষ্ঠের ঘটনা নয়, বরং আকস্মিক দুর্ঘটনা। এক যাত্রীর পড়ে যাওয়ার পরেই আতঙ্ক ছড়িয়ে পড়ে। তবুও প্রশাসনের দাবি, যাত্রী নিরাপত্তায় আরও কড়া নজরদারি ও পরিকাঠামো উন্নয়নের প্রয়োজন রয়েছে, বিশেষত উৎসবের মরশুমে যখন যাত্রীর সংখ্যা কয়েকগুণ বেড়ে যায়।
যাত্রীরা অবশ্য প্রশাসনের ব্যাখ্যায় সন্তুষ্ট নন। তাঁদের অভিযোগ, স্টেশনের রক্ষণাবেক্ষণ ও যন্ত্রপাতির নিয়মিত পরিদর্শনের অভাবেই এমন দুর্ঘটনা ঘটেছে। বিশেষত এস্কেলেটার বন্ধ থাকা এবং পর্যাপ্ত পুলিশি নজরদারি না থাকার কারণে ভিড় সামলানো যায়নি। এক প্রত্যক্ষদর্শী বলেন, “দু’টি ট্রেন একসঙ্গে আসায় মানুষজন দৌড়ে ট্রেনে উঠতে যাচ্ছিলেন। হঠাৎই কেউ পড়ে যাওয়ার পর সবাই একে অপরের উপর পড়ে যায়। সিঁড়িতে এত লোক ছিল যে ওঠা-নামা করাই অসম্ভব হয়ে পড়ে।”
দুর্ঘটনার পর যাত্রী ও স্থানীয়দের মধ্যে ক্ষোভ ছড়িয়ে পড়ে। অনেকে দাবি করেছেন, রেলস্টেশনে সিসিটিভি নজরদারি, কার্যকর লাউডস্পিকার ঘোষণা এবং জরুরি চিকিৎসা ব্যবস্থার ঘাটতি রয়েছে। তাঁদের মতে, উৎসবের সময় বিশেষ নিরাপত্তা ব্যবস্থা ও অতিরিক্ত কর্মী নিয়োগ করা উচিত, যাতে ভবিষ্যতে এমন পরিস্থিতি এড়ানো যায়।
রেল কর্তৃপক্ষ ইতিমধ্যেই ঘটনার তদন্তের নির্দেশ দিয়েছে। কীভাবে ফুটওভারব্রিজে অতিরিক্ত ভিড় তৈরি হয়েছিল এবং এস্কেলেটার কেন বন্ধ ছিল, তা খতিয়ে দেখা হবে বলে সূত্রের খবর।
বর্ধমানের এই দুর্ঘটনা আবারও সামনে এনে দিল রেলস্টেশনগুলিতে যাত্রী সুরক্ষার প্রশ্ন। প্রতিদিন লক্ষাধিক মানুষ যে স্টেশন দিয়ে যাতায়াত করেন, সেখানে সামান্য অব্যবস্থাপনাই যে বড় বিপদের কারণ হতে পারে, তা এই ঘটনাই প্রমাণ করল। যাত্রীরা এখন একটাই দাবি তুলেছেন— “ভিড় নিয়ন্ত্রণ ও নিরাপত্তা নিশ্চিত করা হোক, যাতে আর কোনো দুর্ঘটনা না ঘটে।”