স্মৃতির ভাঁজ খুলে জশ্ন-এ-রেখতায় আবেগে ভাসলেন গুলজার

Story by  atv | Posted by  Aparna Das • 19 h ago
জশ্ন-এ-রেখতা-এ গুলজার
জশ্ন-এ-রেখতা-এ গুলজার
 
মালিক আসগর হাশমি / নয়া দিল্লি

অভিনেত্রী দিব্যা দত্ত যখন কবি, লেখক ও গীতিকার গুলজারের স্মৃতিগুলো স্পর্শ করছিলেন, বহু বছর ধরে চাপা পড়ে থাকা আবেগের স্তরগুলো হঠাৎ ভেঙে বেরিয়ে এল। শ্রোতাদের চোখে অশ্রু, আর মঞ্চে বসে থাকা গুলজারের কণ্ঠ তখন আবেগে থমকে গেল, এক সময় শব্দও তাঁর সঙ্গ ছাড়ল।
 
শুক্রবার সন্ধ্যায় নতুন করে সাজানো যমুনা রিভারফ্রন্ট ব্যনসেরায় তিন দিনের জশ্ন-এ-রেখতা-র উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে এই অনন্য মুহূর্ত তৈরি হয়, উর্দু ভাষা ও তার সঙ্গে জড়িয়ে থাকা সংস্কৃতিকে উদযাপনের এই উৎসব উদ্বোধন করেন দিল্লির লেফটেন্যান্ট গভর্নর ভি.কে. সাক্সেনা। 
উর্দুপ্রেমীদের কাছে অত্যন্ত প্রতীক্ষিত এই উৎসবের প্রথম সেশনেই আবেগে ভাসল পরিবেশ। সাক্সেনা গুলজারকে “এক বিরল সম্পদ ও বহুমুখী প্রতিভা” বলে অভিহিত করেন। কিন্তু আসল জাদু ছড়িয়ে পড়ে যখন ‘সংবাদ’, কথোপকথন পর্বে দিব্যা  দত্ত তাঁর শৈশব, সম্পর্ক ও জীবনের অবিস্মরণীয় স্মৃতিগুলো নিয়ে আলোচনা শুরু করেন।
 
গুলজার জানান, তিনি তাঁর বাবাকে কখনও ‘পিতাজি’, কখনও ‘পাপা জি’, আবার কখনও ‘আব্বু জি’ বলে ডাকতেন। যদিও তিনি মুসলিম-প্রধান এক গ্রামে (বর্তমান পাকিস্তান) জন্মেছিলেন, সেই গ্রামের শিশুদের মুখে বাবার জন্য ‘আব্বু জি’ সম্বোধনটি তাঁর এত ভালো লেগেছিল যে তিনি নিজেই তাঁর বাবাকে সেই নামে ডাকতে শুরু করেন।
 
এমনই এক আবেগঘন স্মৃতিতে তিনি বললেন, “আব্বুজি, আমি এখন সাঁতার শিখেছি… কিন্তু তীর খুঁজে পাই না।” প্রয়াত  বাবাকে সম্বোধন করেই যেন কথাটি বলছিলেন তিনি।
 
শৈশবে স্কুলে ‘বৈতবাজি’, অন্তাক্ষরির মতো কবিতার খেলার মধ্যে ভাষার ঝলক দেখানোর জন্য তিনি আলাদা নজরে পড়তেন। শিক্ষক উৎসাহ দিতেন, আর জিততে হলে তিনি কখনও কখনও কৌশলে বিদ্যমান কবিতায় পরিবর্তন এনে নিজের বলে শুনিয়ে দিতেন। সেই সামান্য ‘কবিতার কারচুপি’ই পরবর্তী সময়ে তাঁর কবি হয়ে ওঠার প্রথম ধাপ হয়ে দাঁড়ায়। তখনকার দিনে কবিদের ‘তখল্লুস’ নেওয়ার রীতি ছিল, সেই সময়েই তিনি নিজের নাম রাখেন ‘গুলজার’ এবং পরে সেটিই হয়ে ওঠে তাঁর সম্পূর্ণ পরিচয়।
 
জশ্ন-এ-রেখতা অনুষ্ঠান
 
কিন্তু তাঁর বাবা এসবকে “উদ্দেশ্যহীন ঘোরাফেরা” মনে করতেন। তিনি চাইতেন গুলজার কবিতা ছেড়ে “ঠিকঠাক কোনও চাকরি” করুন। কে জানত, সেই “উদ্দেশ্যহীন ঘোরাফেরাই” একদিন ভারতীয় কবিতা, গান ও সিনেমাকে দিয়ে যাবে এক অমূল্য রত্ন? এই কারণেই লেফটেন্যান্ট গভর্নরও গর্ব করে বলেন, “আমি নিজেকে সৌভাগ্যবান মনে করি যে গুলজার সাহেবের সঙ্গে এক মঞ্চ ভাগ করছি।”
 
তবুও গুলজারের মনে আজও ব্যথা বয়ে বেড়ায়, কারণ তাঁর বাবা তাঁর সাফল্য দেখতে পাননি। “আব্বুজি জীবিত ছিলেন না, সবকিছু দেখার আগে তিনি চলে গেলেন,” বলেন তিনি। আর তাঁর মা তো আরও আগেই, যখন তিনি ছোট, পৃথিবী ছেড়ে চলে যান। দিব্যা দত্ত তাঁর মায়ের কথা তুলতেই গুলজারের চোখ ভিজে ওঠে। কোমল অথচ বেদনাভরা কণ্ঠে তিনি বলেন, “আম্মা খুব তাড়াহুড়োয় ছিলেন… যেন ঈশ্বরকে কোথাও দেখে দৌড়ে চলে গেলেন।” তাঁকে বলা হয়েছিল, তাঁর চোখগুলো নাকি মায়ের মতো। তাঁর কানে ছিদ্রও নাকি করেছিলেন তাঁর মা, কোনো মানত পূরণ হওয়ার পর। কিন্তু তিনি মায়ের মুখ মনে করতে পারেন না।
 
আলোচনার সময় তিনি স্নেহভরে স্মরণ করেন প্রয়াত অভিনেতা সঞ্জীব কুমারকে, যাকে তিনি আদরের নামে ‘হরিভাই’ বলে ডাকতেন। কবিতা, উর্দু, সিনেমা, বন্ধুরা, যেখানেই গিয়েছেন, গুলজারের কণ্ঠে ছিল সেই একই সুর, যা কেবলই জন্মায় এক প্রকৃত শিল্পীর অন্তর থেকে। গুলজার বলেন, “উর্দু হলো হৃদয়ের ও ভালোবাসার ভাষা।” 
 
তিনি বাংলা, পাঞ্জাবি ও আওধিও ভালোবাসেন, কিন্তু উর্দুর মাধুর্য ও সৌন্দর্যের প্রতি তাঁর প্রেম অন্যরকম। “উর্দু দারিদ্র্যেও মানুষকে ধনী মনে করায়। এক ফকিরও যদি পরিশীলিত উর্দুতে কথা বলে, তিনি যেন নবাব মনে হন।” আর জশ্ন-এ-রেখতার জৌলুস দেখে বিস্মিত হয়ে বললেন, “উর্দুকে এই উচ্চতায় পৌঁছে দেওয়া… সত্যিই অবিশ্বাস্য।” 
 
জশ্ন-এ-রেখতা-এ গুলজার ও দিব্যা দত্ত

ব্যনসেরার সেই রাত ধীরে ধীরে স্মৃতির আলোয় পাকা এক সন্ধ্যায় রূপ নিল। চারদিকে উর্দুশিল্পের অনুরাগীদের উজ্জ্বল চোখ, আর বাতাস ভরে উঠল শব্দের সুগন্ধে। যে এলাকা একসময় বস্তির জন্য পরিচিত ছিল, আজ তা হয়ে উঠেছে দিল্লির অন্যতম মনোরম সাংস্কৃতিক কেন্দ্র। এক পুলিশ সদস্য হাসতে হাসতে বললেন, “স্যার, এক বছর আগেও এখানে বস্তি ছিল… এখন দেখুন, যেন বাগান ফুটে উঠেছে।”
 
ফুলের বাগানের পাশে রাতের অন্ধকারও তখন কোমল। দূরের ফ্লাইওভারের গাড়ির আলো ক্ষুদ্র জোনাকির মতো ঝিলমিল করছিল। আর সেই দৃশ্য দেখতে দেখতে মনে হচ্ছিল, আমরা শুধু এক বৃহৎ শহরের বাসিন্দা নই, আমরা এক বিশাল গল্পেরও অংশ। 
 
আর সেই গল্পের সবচেয়ে সুন্দর পাতাগুলোর একটি ছিল এই রাত, যখন গুলজার তাঁর স্মৃতির ঝাঁপি খুলে আবার বললেন, “আব্বুজি, আমি এখন সাঁতার শিখেছি… কিন্তু তীর খুঁজে পাই না।”