নয়া দিল্লি
হরিয়ানার মাটিতে আজও এমন মানুষ আছেন, যারা নিঃশব্দে কাজ করে সমাজকে বদলে দিচ্ছেন। 'আওয়াজ দ্যা ভয়েস' তাদের মধ্য থেকেই বেছে নিয়েছে দশজন অসাধারণ চেঞ্জ মেকার, পুরুষ ও নারী, যারা প্রতিকূলতা, দারিদ্র্য এবং সামাজিক বাধা পেরিয়ে এগিয়ে এসেছেন মানুষের জন্য কাজ করতে। হরিয়ানার সবচেয়ে পিছিয়ে থাকা অঞ্চল থেকে উঠে আসা এই মানুষরা শিক্ষা, স্বাস্থ্য, পরিবেশ, নারীর ক্ষমতায়ন, খেলাধুলা, ইতিহাস, মানবিক সহায়তা, জীবনের নানা ক্ষেত্রেই আলোড়ন সৃষ্টি করেছেন।
এই ধারাবাহিকতার উদ্দেশ্য কেবল তাদের পরিচিত করা নয়, বরং সমাজের সামনে এমন অনুপ্রেরণা তুলে ধরা, যারা নিজের ব্যক্তিগত স্বার্থের ঊর্ধ্বে উঠে জনকল্যাণকে জীবনধর্ম হিসেবে গ্রহণ করেছেন।
হাজি ইব্রাহিম খান
মেওয়াটের হাজি ইব্রাহিম খান তিন দশকেরও বেশি সময় ধরে জল সংরক্ষণ অভিযানের সাথে যুক্ত। আরাভল্লী জল বিরাদরির সভাপতি হিসেবে তিনি নিষ্ঠার সঙ্গে দায়িত্ব পালন করে যাচ্ছেন। তিনি বলেন, “শৈশব থেকেই আমরা পানির চরম সংকট দেখেছি। গৃহস্থালির সব কাজ সামলানো মহিলারাই সবচেয়ে বেশি কষ্ট করেন এবং দীর্ঘ পথ পাড়ি দিয়ে জল আনতে হয়। ‘ওয়াটারম্যান’ রাজেন্দ্র সিং–এর কাছ থেকেই আমার প্রেরণা আসে। প্রথমে আমি ঘাট্টা শমশাবাদের কাছে দুই পাহাড়ের মাঝখানে একটি বাঁধ তৈরি করি। এতে গ্রামের মানুষের পানীয় জলের সংকট মিটে যায়। পরে তরুণ ভারত সংঘের সাহায্যে পাট খোরি, ফিরোজপুর ঝিরকা, গিয়াসানিয়ান বাস, মেউলি সহ আরও বহু গ্রামে সাম্প্রদায়িক ট্যাংক (জহাদ) নির্মাণ করা হয়, এমনকি পাহাড়ের চূড়ায় বন্য প্রাণীদের জন্যও।”
পারভেজ খান
মেওয়াটের পারভেজ খান প্রমাণ করেছেন যে প্রতিভা থাকলে পৃথিবীর যেকোনো প্রান্তে পৌঁছানো সম্ভব। একটি ছোট গ্রামের ছেলে হয়ে তিনি আজ যুক্তরাষ্ট্রে পৌঁছেছেন। মে ২০২৪-এ লুইজিয়ানায় অনুষ্ঠিত এসইসি আউটডোর ট্র্যাক অ্যান্ড ফিল্ড চ্যাম্পিয়নশিপে তিনি ১৫০০ মিটার দৌড়ে সোনার পদক জেতেন, সময় লাগে ৩ মিনিট ৪২.৭৩ সেকেন্ড। তবে তার ব্যক্তিগত সেরা সময় ৩ মিনিট ৩৮.৭৬ সেকেন্ড, যা তিনি ক্যালিফোর্নিয়ায় অর্জন করেন। তিনি ৮০০ মিটার দৌড়েও তৃতীয় স্থান অধিকার করেন।
মুমতাজ খান
নুহ জেলার চাঁদেনি গ্রামের মুমতাজ খান আজ মেওয়াটের কণ্ঠস্বর হয়ে উঠেছেন। তিনি বহু সামাজিক আন্দোলনে অংশগ্রহণ করেছেন এবং গণমাধ্যমের মাধ্যমে তার অঞ্চলের সমস্যাগুলি উত্থাপন করেছেন। শিক্ষা ও মহিলা ক্ষমতায়নের জন্য চাঁদেনি আজ পরিচিত, এ কৃতিত্ব মুমতাজের মতো মানুষের। তিনি বলেন, “শৈশব থেকেই আমি বিভিন্ন প্ল্যাটফর্ম থেকে মেওয়াটের কথা তুলে ধরেছি। জেলা গঠন, কৃষকদের ন্যায্য ক্ষতিপূরণ, শিক্ষা, স্বাস্থ্য ও কর্মসংস্থানের মতো বিষয় নিয়ে আন্দোলনে আমি সক্রিয়ভাবে অংশ নিয়েছি।”
সিদ্দিক আহমদ মেও
ড. সিদ্দিক আহমদ মেও হরিয়ানার একজন সুপরিচিত লেখক ও সমাজকর্মী। তিনি মেওয়াটের ইতিহাস নিয়ে ব্যাপক গবেষণা ও কাজ করেছেন। তিনি বলেন, “মেওয়াটের ইতিহাস নিয়ে আমার প্রথম প্রবন্ধ ১৯৯১ সালে তথ্য ও জনসংযোগ বিভাগের ম্যাগাজিন হরিয়ানা সংলাপ–এ প্রকাশিত হয়। এরপর আরও বহু প্রবন্ধ প্রকাশিত হয়। ১৯৯৭ সালে প্রকাশিত হয় আমার প্রথম বই 'Mewat: A Quest'। ১৯৯৯ সালে আসে দ্বিতীয় বই 'Mevati Culture'। তারপর থেকে আমি বই লিখেই চলেছি এবং ২০২৫ সাল পর্যন্ত মেওয়াটের ইতিহাস, সংস্কৃতি ও লোকসংস্কৃতি বিষয়ে আমার বারোটি বই প্রকাশিত হয়েছে। তিনটি কাব্যগ্রন্থও প্রকাশিত হয়েছে এবং আরও দুটি প্রকাশের অপেক্ষায়। এর পাশাপাশি, আমার প্রায় ২০০টি কবিতা দশটি যৌথ কাব্যসংকলনে অন্তর্ভুক্ত হয়েছে।”
মোহাম্মদ রফিক চৌহান
কর্ণালের মোহাম্মদ রফিক চৌহান পেশায় একজন আইনজীবী এবং সমাজকর্মী। তিনি হরিয়ানা মুসলিম খিদমত সভা নামে স্বেচ্ছাসেবী সংস্থা পরিচালনা করেন, যা শিক্ষা, স্বাস্থ্য, পরিবেশ ও নারীর অধিকার সম্পর্কে জনসচেতনতা গড়ে তুলতে কাজ করে। নারীর অধিকার রক্ষার প্রতি তার অটল অঙ্গীকার বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য, অর্থনৈতিকভাবে দুর্বল মহিলারা যখন আইনের খরচ বহন করতে পারেন না, তখন তিনি তাদের মামলা নিঃশুল্ক পরিচালনা করেন এবং স্টেশনারির খরচও নেন না।
রুকসানা (মধ্যে সাদা হিজাব পরিহিতা)
রুকসানা
নুহ জেলার সুনারি গ্রামের রুকসানা আজ গুরগাঁওয়ে একজন ম্যাজিস্ট্রেট। প্রথম দুই প্রচেষ্টায় তিনি হরিয়ানা বিচার পরিষেবা এবং উত্তর প্রদেশ বিচার পরিষেবা পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হতে পারেননি, কিন্তু হাল ছাড়েননি। অবশেষে তিনি পশ্চিমবঙ্গ বিচার পরিষেবা পরীক্ষায় তৃতীয় স্থান অর্জন করেন। তার সাফল্য হরিয়ানা ও সারা দেশের অসংখ্য মেয়েকে অনুপ্রাণিত করছে, বিশেষত তাদের, যারা মনে করে মেয়েদের জগৎ ঘরের চার দেওয়ালের মধ্যেই সীমাবদ্ধ।
রফিক আহমদ
কর্ণালের ইন্দ্রি এলাকার রফিক আহমদ স্বাধীন ভারতের প্রথম মুসলিম স্নাতক। তিনি জনহিতকর কাজে জীবন উৎসর্গ করেছেন, বিশেষত মসজিদ নির্মাণ ও পুনর্নির্মাণে। তিনি বলেন, “১৯৬০ থেকে ১৯৬২ সালের মাঝখানে বহু মসজিদ ও ঈদগাহ নির্মিত হয়। আমার জীবন এই কাজের মধ্যেই কেটেছে। অনেকেই এই মিশনে যুক্ত হন এবং ধীরে ধীরে এক কাফেলা তৈরি হয়।” তার বিশ্বাস, ইসলামের প্রকৃত মর্মার্থ মানুষের কাছে পৌঁছে দেওয়া অত্যন্ত জরুরি।
রাজেশ খান মচ্ছহারি
সোনিপতের রাজেশ খান মচ্ছহারি একজন আইনজীবী এবং সুপরিচিত সমাজকর্মী। ২০০৬ সাল থেকে তিনি কবরস্থান ইন্তেজামিয়া সঙ্ঘর্ষ সমিতি–র সভাপতি। এই সংস্থা কবরস্থান পরিচালনা, পানি ও বিদ্যুৎ নিশ্চিত করা, অনুপ্রবেশ রোধ, সীমানা প্রাচীর নির্মাণ এবং অজ্ঞাত মৃতদেহ দাফনের মতো গুরুত্বপূর্ণ কাজে নিয়োজিত।
আসলাম খান
গুরগাঁওয়ের আসলাম খান হরিয়ানা আঞ্জুমান চ্যারিটেবল ট্রাস্ট–এর প্রতিষ্ঠাতা, যা গরিব ও অনাথদের সাহায্য করে। তার মায়ের ক্যানসারের চিকিৎসার সময় বহু রোগীকে অর্থের অভাবে ভোগান্তি পেতে দেখে গভীরভাবে ব্যথিত হন। সেখান থেকেই দরিদ্রদের জন্য একটি তহবিল তৈরির সংকল্প নেন। ২০০৩ সালে সংস্থাটি সরকারি নিবন্ধন পায় এবং তারপর থেকে বহু সমর্থক এতে যুক্ত হন।
হোশিয়ার খান
হিসারের হোশিয়ার খান মুসলিম ওয়েলফেয়ার কমিটি-র সভাপতি। এই সংস্থা সংরক্ষণ, মৌলিক সুবিধা এবং সম্প্রদায়ের অধিকার সম্পর্কিত ইস্যুতে কাজ করে। হিসারে মসজিদের অভাব থাকায় ঈদ মুসল্লিদের কষ্ট এড়াতে কমিটির উদ্যোগে ক্রান্তিমান পার্কে ঈদের নামাজের আয়োজন করা হয় এবং পুরো খরচ কমিটিই বহন করে।